রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ অবস্থায় কেউ শরীয়তসম্মত কোনো প্রয়োজনে যদি বাইরে যায় তাহলে সে কাউকে সালাম ও এর জবাব দিতে পারবে কি না? আমাদের এখানে কেউ কেউ বলেন যে, তার জন্য সালাম দেওয়াও নাকি সহীহ নয়। আবার কেউ বলেন, সালাম দেওয়া যাবে। তাই এক্ষেত্রে সঠিক মাসআলা জানতে চাই।
ইতিকাফকারী কোনো প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে সালাম বা সালামের জবাবের জন্য না থেমে রাস্তায় চলতে চলতে কিংবা প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে সারতে সালাম ও সালামের জবাব দিতে পারবে। এতে তার ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। হাদীস শরীফে আছে, আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় (প্রয়োজনে বাইরে গেলে) যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে অতিক্রম করতেন তখন হাঁটা অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিয়ে নিতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৭২)
-মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/৫২৯; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫; ইমদাদুল আহকাম ২/১৪৯
একদিন জুমার নামাযের আগে আমার রুমে পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। সবাই মনে করেছে আমি মসজিদে গিয়েছি। সুতরাং কেউ আমাকে জাগায়নি। যখন আমি সজাগ হই তখন দ্রুত রওয়ানা দেই এবং নিয়ত করে বসা মাত্রই ইমাম সাহেব সালাম ফিরিয়ে দেন। আমি দাঁড়িয়ে মাসবুকের ন্যায় নামায পূর্ণ করি। জানতে চাই আমার ঐ জুমার নামায কি আদায় হয়েছে?
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে ইমামের সালাম ফিরানোর আগেই যেহেতু আপনি জুমার নামাযে শরীক হয়েছেন তাই আপনার জুমার নামায সহীহ হয়েছে। হযরত শু‘বা রাহ. বলেন,
سَأَلْتُ الْحَكَمَ، وَحَمَّادًا، عَنِ الرَّجُلِ يَجِيءُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ قَبْلَ أَنْ يُسَلِّمَ الْإِمَامُ، قَالَا: يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ.
আমি হাকাম ও হাম্মাদ রাহ.-কে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, যে জুমার দিনে ইমামের সালাম ফিরানোর আগে (জুমার নামাযে) উপস্থিত হয়েছে। উত্তরে তারা বললেন, সে দুই রাকাত নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৫৩৯৮)
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৪৫৭৮; আলমাবসূত, সারাখসী ২/৩৫; বাদায়েউস সনায়ে ১/৫৯৯; ফাতহুল কাদীর ২/৩৫; রদ্দুল মুহতার ২/১৫৭
রমযানের পূর্বে ট্রেনে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। মাঝে ফজরের সময় এক স্টেশনে ট্রেনটি থামে। ঐ স্টেশনে ট্রেন সাধারণত একটু দীর্ঘ সময় অবস্থান করে। তাই আমি পস্নাটফরমের এক কামরায় ফজরের জামাতে শরিক হই। আমরা যখন বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ছি তখন ট্রেন ছাড়ার জান্য সংকেত দেওয়া হয়। তাই আমি তাড়াহুড়ো করে ইমামের আগেই সালাম ফিরিয়ে ট্রেনে উঠি। ইমামের আগে সালাম ফিরানোর কারণে কি আমার ঐ নামায নষ্ট হয়ে গেছে? ঐ নামায কি পুনরায় আদায় করতে হবে?
আপনি যদি তাশাহহুদ পড়ার পর সালাম ফিরিয়ে থাকেন তাহলে আপনি যেহেতু ওজরবশতকরেছেন তাই আপনার নামায আদায় হয়ে গেছে। আর যদি তাশাহহুদ পড়ার পূর্বে সালাম ফিরিয়েথাকেন তাহলে ঐ নামায আদায় হয়নি। তা পুনরায় আদায় করে নিতে হবে।
প্রকাশ থাকে যে, মুকতাদির জন্য নামাযের সালামেও ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব। বিনাওজরে ইমামের পূর্বে সালাম ফেরানো মাকরূহে তাহরীমী। বিনা ওজরে এমনটি করলে উক্ত নামাযপুনরায় আদায় করতে হবে।
-হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী ১৬৯; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৯৭; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২/১৯০; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাদ্দুর ১/২৩০; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫২৫
গত রমযানে আমি একদিন জামাতের সাথে তারাবীতে নামায শেষ করে জরুরতে মসজিদের বাইরে যাই। ফিরে এসে ইমাম সাহেবকে বিতিরের তৃতীয় রাকাতে পাই। আমি তখন জামাতে শরিক হই। ইমাম সাহেব যখন তাকবীর বলে দুআ কুনূত পড়েন তখন আমিও তার সাথে দুআ কুনূত পড়ি। এরপর ইমাম সাহেব তৃতীয় রাকাত শেষ করে সালাম ফিরালে আমি দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট দু রাকাত পূর্ণ করি। তাতে পুনরায় আর দুআ কুনূত পড়িনি। নামায শেষে একজন মুসল্লি আমাকে বলেন, আপনার নামায আদায় হয়নি। কেননা প্রথমবার আপনি যখন ইমামের সাথে দুআ কুনূত পড়েছেন তা ছিল আপনার প্রথম রাকাত। ইমামের অনুসরণে তখন মূলত তা পড়েছেন। এরপর আপনার তৃতীয় রাকাত যেটা ছিল তাতে দুআ কুনূত পড়া তো আপনার জন্য ওয়াজিব ছিল। ইচ্ছাকৃত ওয়াজিব ত্যাগ করার কারণে আপনার নামায নষ্ট হয়ে গেছে। হুজুরের কাছে বিষয়টির প্রকৃত সমাধান জানতে চাচ্ছি।
উক্ত মুসল্লির কথা ঠিক নয়। কেননা মাসবুক ইমাম সাহেবের সাথে দুআ কুনূত পড়লে কিংবা তৃতীয়রাকাত পেলে মাসবুকের দুআ কুনূতের ওয়াজিব আদায় হয়ে যায় এবং এটা তার জন্য তৃতীয়রাকাত হিসেবেই গণ্য হয়। তাই ইমামের সালামের পর পূর্বের দু রাকাত আদায় করতে হয়।সুতরাং আপনার বিতর নামায যথাযথভাবেই আদায় হয়েছে।
-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৭১; হালবাতুল মুজাল্লী ২/৩৮৫; শরহুল মুনইয়াহ ৪২১; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী ২১১; আদ্দুররুল মুখতার ২/১০-১১
একবার আমি ইশার নামাযে মাসবুক হই। ইমাম সালাম ফেরানোর পর যখন বাকি নামায পড়তে দাঁড়ালাম তখন কত রাকাত ছুটেছে তা বিলকুল মনে আসছে না। হঠাৎ মাথায় আসল পাশের মুসল্লি তো আমার সাথেই এসেছে। সে যত রাকাত পড়ে তত রাকাত পড়লে তো হয়ে যায়। এ বলে আমি তার মতো নামায পড়ে সালাম ফিরাই। জানার বিষয় হল, এভাবে নামায পড়ার কারণে নামাযের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি? আদৌ নামায হয়েছে কি না তাতেও আমি সন্দিহান।
কত রাকাত ছুটেছে তা মনে না থাকলে পাশের মুসল্লিকে লক্ষ্য করে সে অনুযায়ী নামায পূর্ণ করা জায়েয আছে। এভাবে নামায পড়লে তা আদায় হয়ে যায়। তাই আপনার নামাযও সহীহ হয়েছে। এ নিয়ে সংশয়ে থাকার প্রয়োজন নেই।
-ফাতাওয়া খানিয়া ১/১০৪; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৯৮; আলবাহরুর রায়েক ১/৩৭৮; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৯৭
আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব একদিন জানাযার নামায পড়ানোর সময় ভুলে ৩য় তাকবীর দিয়ে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। মুসল্লিরা সাথে সাথে লোকমা দেয়। পরে ইমাম সাহেব পুনরায় শুরু থেকে জানাযা নামায পড়ালেন। জানতে চাই, তার এ কাজ কি ঠিক হয়েছে? দ্বিতীয় জানাযা কি সহীহ হয়েছে?
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে প্রথম জানাযা আদায় হয়নি। তাই দ্বিতীয়বার জানাযা পড়া ঠিক হয়েছে। জানাযা নামাযে চার তাকবীরই ফরয। একটি ছুটে গেলেই নামায হবে না। অবশ্য ইমাম সাহেব তৃতীয় তাকবীর শেষে ভুলে সালাম ফিরানোর পর কোনো কথাবার্তা না বলে যদি ছুটে যাওয়া তাকবীরটি বলে নিতেন এবং তারপর আবার সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতেন তাহলে প্রথম জানাযা নামাযটিই সহীহ হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় জানাযা নামাযটি আর পড়া লাগত না।
-ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৫১; হাশিয়াতুত তহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ পৃ. ৩২২; আদ্দুররুল মুখতার ২/২০৯
বিতর নামাযে কোন্ দুআ কুনূত পড়ব? অনেকে বলেন, আমরা যে দুআ কুনূত পড়ি-
)اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ، اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشَى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ (
সেটি সঠিক নয়। তারা অপর একটি দুআ কুনূত বলে। কোন্টি সঠিক?
প্রশ্নোক্ত দুআ কুনূত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এটিকে ভুল বলা ঠিক নয়। বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় আবদুর রহমান আসসুলামী রাহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন আমরা যেন কুনূতে নিম্নোক্ত দুআটি পড়ি-
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ، وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ، وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ، اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشَى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ الْجِدَّ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ.
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৬৯৬৫
শব্দের সামান্য তারতম্যসহ অন্যান্য বর্ণনায়ও এ দুআটি এসেছে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার এক বর্ণনায় وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ -এ দু’টি বাক্য বর্ধিত এসেছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০৩৩৭) শরহু মাআনিল আসারের একটি বিশুদ্ধ বর্ণনায় وَنَشْكُرُكَ শব্দটিও রয়েছে। (শরহু মাআনিল আসার ১/১৭৭)
এছাড়া হযরত আলী রা. যেভাবে পড়তেন তাতেও وَنَشْكُرُكَ শব্দটি পাওয়া যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৩/১১৪
আর প্রশ্নোক্ত দুআটি উপরোক্ত বর্ণনাসমূহেরই সমন্বিত রূপ। এভাবে পড়ার দ্বারা উপরোক্ত সকল বর্ণনার উপর আমল হয়ে যায়।
অতএব এইসব বর্ণনার আলোকে দুআটি পূর্ণ পাঠ এভাবে হয়-
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ، اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشَى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ الْجِدَّ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ.
(আরো দেখুন : আলআওসাত, ইবনুল মুনযির ৫/২১৮; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ২/২১০;আলমুদাওওয়ানাতুল কুবরা ১/১১০)
সুনানে বাইহাকীর এক বর্ণনায় এসেছে যে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুনূত শিক্ষা দিয়েছেন। এরপর শব্দের সামান্য তারতম্যসহ উপরোক্ত দুআটিই উল্লেখিত হয়েছে। (আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ২/২১০, আলমুদাওওয়ানাতুল কুবরা ১/১০১)
উল্লেখ্য, কুনূতের জন্য হাদীস শরীফে যেমন উপরোক্ত দুআটি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তেমনি আরেকটি দুআও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাসান ইবনে আলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিতিরে পড়ার জন্য কয়েকটি বাক্য শিক্ষা দিয়েছেন, তাহল-
اللَّهُمَّ اهْدِنِي فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِي فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنِي شَرَّ مَا قَضَيْتَ، فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلَا يُقْضَى عَلَيْكَ، وَإِنَّهُ لَا يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ.
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪২৫
ইমাম নববী রাহ. বলেন, আমাদের অনেকেই বলেন, উভয় দুআ একত্রে পড়াটাই উত্তম। (শরহুল মুহাযযাব ৩/৪৭৫-৭৮) শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ. ইমাম কাসানী রাহ. প্রমূখ ফকীহগণও বিতিরের নামাযে উভয় দুআ একত্রে পড়াকে পছন্দ করতেন। (আলমাবসূত, সারাখসী ১/১৬৫; বাদায়েউস সনায়ে ২/২৩২)
তবে কেউ যদি একটি দুআই পড়তে চায় তাহলে প্রথম দুআটি পড়াই উত্তম হবে। কেননা বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. নিজে বিতিরের কুনূতে এ দুআ পড়াকে পছন্দ করতেন এবং অন্যকে পড়তে আদেশ করতেন। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৪৯৯৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৬৯৬৪
তাবেয়ী হাসান বাসরী রাহ.ও কুনূতে এ দুআটিই পড়তেন। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৪৯৮২
একবার আমি তিন দিনের জন্য তাবলীগে গিয়েছি। আমাদের আমীর সাহেব গাশ্ত করার সময় এক হিন্দুকে দাওয়াত দিয়ে মসজিদে নিয়ে এসেছেন। আমীর সাহেব জানতেন না যে, এ লোক হিন্দু। আবার ঐ লোকও বলেনি পরে স্থানীয় লোকজন ঐ হিন্দু ব্যক্তিকে মসজিদে দেখে আমাদেরকে অনেক বকাবকি করেছেন। জানার বিষয় হল, হিন্দুরা মসজিদে প্রবেশ করা কি নাজায়েয?
দ্বীনী কথা শোনানো ও হেদায়েতের উদ্দেশ্যে হিন্দু বা বিধর্মীকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেওয়া জায়েয। হাদীস শরীফে এসেছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী সাকীফ গোত্রের কাফের প্রতিনিধি দলকে মসজিদে রেখেছেন (যাতে দ্বীনী কথা শুনে) তাদের অন্তর নরম হয়।-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৯১৩
অতএব প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে ঐ হিন্দুকে মসজিদে নিয়ে আসা অন্যায় হয়নি। এ ছাড়া আপনারা তো না জেনেই তাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সুতরাং এ নিয়ে স্থানীয় লোকদের আপত্তি করা ঠিক হয়নি।
-শরহুস সিয়ারিল কাবীর ১/৯৬; বাদায়েউস সানায়ে ৪/৩০৬; আল বাহরুর রায়েক ৮/২০৩
আমার বাড়ির পাশে এক হিন্দু লোক থাকে। সে আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল। আমি চাচ্ছি তাকে কিছু দান-সদকা করতে। এখন হুযুরের নিকট জানার বিষয় হল, আমি কি তাকে সদাকাতুল ফিতর বা মানতের টাকা দিতে পারব? আর তাকে নফল দান করলে সওয়াব পাওয়া যাবে কি?
অমুসলিমদেরকে নফল সদকা দেওয়া জায়েয এবং এতে সওয়াবও রয়েছে। তবে তাদেরকে সদকায়ে ফিতর বা মানতের টাকা দেওয়া যাবে না। কেননা সদকায়ে ফিতর বা মানতের টাকা বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী শুধু মুসলিম গরীবদের হক।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০৫১২; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৬১; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৯
সফর অবস্থায় নামায কসর করা কি জরুরি? এক ব্যক্তি বলল কসর জরুরি নয়। কেউ চাইলে পুরো নামাযও পড়তে পারে আবার কসরও করতে পারে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তার এ কথার পর বিষয়টি নিয়ে আমি সংশয়ে পড়ে যাই। দয়া করে আমাকে এর সমাধান জানাবেন।
মুসাফিরের জন্য চার রাকাতবিশিষ্ট ফরয নামায একাকী পড়লে বা মুসাফির ইমামের পেছনে আদায় করলে কসর করা জরুরি। এক্ষেত্রে পূর্ণ নামায পড়া ঠিক নয়। ঐ লোকের বক্তব্য সহীহ নয়।
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
فُرِضَتِ الصَّلَاةُ رَكْعَتَيْنِ رَكْعَتَيْنِ فِي الْحَضَرِ وَالسَّفَرِ، فَأُقِرَّتْ صَلَاةُ السَّفَرِ، وَزِيدَ فِي صَلَاةِ الْحَضَرِ.
নামায ফরয করা হয়েছে মুকিম অবস্থায় এবং সফরে দুই দুই রাকাত করে। অতপর সফর অবস্থায় নামায দুই রাকাতই বহাল রাখা হয়েছে আর মুকিম অবস্থার নামাযকে দুই রাকাত বৃদ্ধি করা হয়েছে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৮৫
সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
إِنِّي صَحِبْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي السَّفَرِ، فَلَمْ يَزِدْ عَلَى رَكْعَتَيْنِ حَتَّى قَبَضَهُ اللهُ، وَصَحِبْتُ أَبَا بَكْرٍ، فَلَمْ يَزِدْ عَلَى رَكْعَتَيْنِ حَتَّى قَبَضَهُ اللهُ، وَصَحِبْتُ عُمَرَ، فَلَمْ يَزِدْ عَلَى رَكْعَتَيْنِ حَتَّى قَبَضَهُ اللهُ، ثُمَّ صَحِبْتُ عُثْمَانَ، فَلَمْ يَزِدْ عَلَى رَكْعَتَيْنِ حَتَّى قَبَضَهُ اللهُ وَقَدْ قَالَ اللهُ: لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ.
আমি সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হয়েছি। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত দুই রাকাতের অধিক পড়েননি। এবং আবু বকর রা.-এর সঙ্গী হয়ে সফর করেছি, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত দুই রাকাতের বেশি পড়েননি। উমর রা.-এর সঙ্গী হয়ে সফর করেছি, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত দুই রাকাতের বেশি পড়েননি। উসমান রা.-এর সাথে সফর করেছি, তিনি মৃত্যু পর্যন্ত দুই রাকাতের বেশি পড়েননি। আর আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ.
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৮৯
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে সফরের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
رَكْعَتَيْنِ رَكْعَتَيْنِ، مَنْ خَالَفَ السُّنَّةَ كَفَرَ.
সফরের নামায দুই রাকাত। যে সুন্নাহকে পরিত্যাগ করল সে (এ হুকুমের) অমান্য করল।-মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৪২৮১
সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম ইরশাদ করেছেন,
صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللهُ بِهَا عَلَيْكُمْ، فَاقْبَلُوا صَدَقَتَهُ.
(কসর নামায) সদকা, আল্লাহ তাআলা তা তোমাদের দান করেছেন। অতএব, তোমরা আল্লাহ তাআলার দানকে কবুল করে নাও। (হাদীস নং ৬৮৬)
সহীহ মুসলিমে মূসা ইবনে সালামা রাহ. থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন,
سَأَلْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ: كَيْفَ أُصَلِّي إِذَا كُنْتُ بِمَكَّةَ، إِذَا لَمْ أُصَلِّ مَعَ الْإِمَامِ؟ فَقَالَ : رَكْعَتَيْنِ سُنَّةَ أَبِي الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা-কে জিজ্ঞাসা করলাম মক্কায় অবস্থানকালে ইমামের পেছনে যখন নামায আদায় না করব তখন কীভাবে নামায পড়ব? তিনি বললেন দুই রাকাত পড়বে। এটা আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। (হাদীস ৬৮৮)
সফর অবস্থায় নামায কসর করা সম্পর্কে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। এ সকল হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর অবস্থায় সর্বদা নামায কসর পড়েছেন। সফর অবস্থায় তিনি চার রাকাতবিশিষ্ট ফরয নামায পূর্ণ পড়েছেন এটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
অনুরূপ এটাও জানা গেল যে সফর অবস্থায় নামায ফরযই থাকে কেবল দুই রাকাত করে।
এসকল হাদীস ও আছারের উপর ভিত্তি করে ফিকহবিদগণ বলেছেন মুসাফির যখন একাকী বা মুসাফির ইমামের পেছনে নামায পড়বে তখন তার জন্য চার রাকাতবিশিষ্ট ফরয নামায কসর করা ওয়াজিব।
হাঁ, মুসাফির যদি মুকীম ইমামের পেছনে নামায পড়ে সেক্ষেত্রে সে ইমামের অনুসরণে চার রাকাতই পড়বে। দুই রাকাত পড়বে না।
এক্ষেত্রে মুক্তাদির জন্য চার রাকাত নামায পড়া সাহাবা কেরামের আমল ও আছার দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে। যেমন :
নাফে রাহ. বলেন,
أنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يُصَلِّي وَرَاءَ الْإِمَامِ، بِمِنًى أَرْبَعاً. فَإِذَا صَلَّى لِنَفْسِهِ، صَلَّى رَكْعَتَيْنِ.
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. মিনায় ইমামের পেছনে চার রাকাত পড়তেন। আর যখন একাকী পড়তেন তখন দুই রাকাত পড়তেন। -মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদীস ৫০৬
আমি আমার বাড়ির ২টি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে থাকি। কয়েকমাস থেকে তা খালি পড়ে আছে। গত সপ্তাহে এক ভাড়াটিয়ার সাথে কথা হয়েছে যে, সে একটি ভাড়া নিবে। এখন জানতে পারি যে, সে হিন্দু। আমার জানার বিষয় হল, হিন্দুকে ঘর ভাড়া দেওয়া কি জায়েয?
জ্বী, অমুসলিমকে ঘর ভাড়া দেওয়া জায়েয। এবং তার থেকে প্রাপ্ত ভাড়াও বৈধ। তবে এমন কাউকে ভাড়া দেওয়া যাবে না যার দ্বারা মুসলিম সমাজে বিধর্মীদের আচার-অনুষ্ঠান প্রচার পায় কিংবা যার দ্বারা মুসলমানদের দ্বীনী অনুভূতিতে আঘাত আসে।
-আলমাবসূত, সারাখসী ১৫/১৩৪; আলমুহীতুল বুরহানী ১১/৩৪৮; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৩/১৫০
জনৈক ইমাম সাহেব জানাযার নামাযে তিন তাকবীর বলে সালাম ফিরিয়েছেন। নামায শেষে এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে ইমাম সাহেব পুনরায় চার তাকবীরের সাথে নামায পড়ান। জানতে চাই, আমাদের প্রথম নামাযই বিশুদ্ধ ছিল কি না? নাকি দ্বিতীয়বার পড়া যথাযথ হয়েছে?
প্রথম জানাযায় তিন তাকবীর বলে সালাম ফিরানোর কারণে তা আদায় হয়নি। সুতরাং পরে আবার আদায় করা যথাযথ হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, জানাযা নামাযে চার তাকবীর ফরয। একটি তাকবীর কম হলেও নামায আদায় হবে না। উল্লেখ থাকে যে, জানাযা নামাযে তিন তাকবীরের পর ভুলে সালাম ফিরিয়ে নিলে কথাবার্তা না বলে থাকলে চতুর্থ তাকবীর বলে সালাম ফিরাবে। তাহলে নামায হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পুনরায় তা আদায় করতে হবে না।
-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/৫০; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৮২; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী পৃ. ৩২২
আমি যোহরের নামাযের চতুর্থ রাকাতে ইমামের সাথে শরিক হই। ইমাম সাহেব তার কোনো ভুলের জন্য নামায শেষে সাহু সিজদা আদায় করেন। কিন্তু আমি সাহু সিজদা না দিয়ে বসে থাকি। কারণ আমি এক ব্যক্তির কাছে শুনেছিলাম, মাসবুক সাহু সিজদা না দিয়ে বসে থাকবে। কিন্তু নামাযের পর পাশের এক মুসল্লি বলল, মাসবুক ব্যক্তিও ইমামের সাথে সাহু সিজদায় শরিক হবে। অন্যথায় তার নামায সহীহ হবে না।
এখানে কার কথাটি সঠিক? জানালে উপকৃত হব।
মাসবুক ইমামের সাথে সাহু সিজদায় শরিক হবে- এটাই সঠিক। তবে সাহু সিজদার পূর্বে ইমাম যখন সালাম ফিরান তখন সে সালাম না ফিরিয়ে চুপ করে বসে থাকবে। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন,
إِذَا انْتَهَى إِلَى الْإِمَامِ وَقَدْ سَهَا قَبْلَ ذَلِكَ فَلْيَسْجُدْ مَعَ الْإِمَامِ، ثُمَّ لِيَقْضِ مَا سَبَقَ بِهِ .
কেউ যদি ইমামের সাথে নামাযে শরিক হয় এমন অবস্থায় যে, ইমাম পূর্বে কোনো ভুল করেছে, তাহলে মাসবুক যেন ইমামের সাথে সিজদায় শরিক হয়। অতপর তার ছুটে যাওয়া রাকাত আদায় করে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৪৫৯২
উল্লেখ্য, মাসবুক যদি কোনো কারণে ইমামের সাথে সাহু সিজদা না করে তাহলে নিজের ছুটে যাওয়া রাকাত আদায়ের পর সাহু সিজদা করলেও নামায হয়ে যাবে। কিন্তু তাও যদি না করে তবে ঐ নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনি যেহেতু পরেও সাহু সিজদা করেননি তাই ঐ নামায পুনরায় আদায় করতে হবে।
-কিতাবুল আছল ১/২০১, ২০২; মাবসূত, সারাখসী ১/২২৫; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪২১; ৪২২ ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২৮; হালবাতুল মুজাল্লী ২/৪৬৩; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৮২
আমি নিয়মিত নামায পড়ি। কিছুদিন যাবৎ প্রায়ই নামাযের মধ্যে রাকাত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়। তিন রাকাত হল না চার রাকাত। এ অবস্থায় আমি কীভাবে নামায আদায় করব? বিস্তারিত জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনি প্রবল ধারণার উপর ভিত্তি করে বাকি নামায পূর্ণ করবেন।
আর যদি রাকাত সংখ্যার ব্যাপারে প্রবল ধারণা না হয় তাহলে কম সংখ্যাটা ধর্তব্য হবে এবং এ হিসেবে বাকি নামায পূর্ণ করবেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক রাকাতের পর বৈঠক করে তাশাহহুদ পড়বেন। আর শেষ বৈঠকে সাহু সিজদা দিবেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا سَهَا أَحَدُكُمْ فِي صَلاَتِهِ فَلَمْ يَدْرِ وَاحِدَةً صَلَّى أَوْ ثِنْتَيْنِ فَلْيَبْنِ عَلَى وَاحِدَةٍ، فَإِنْ لَمْ يَدْرِ ثِنْتَيْنِ صَلَّى أَوْ ثَلاَثًا فَلْيَبْنِ عَلَى ثِنْتَيْنِ، فَإِنْ لَمْ يَدْرِ ثَلاَثًا صَلَّى أَوْ أَرْبَعًا فَلْيَبْنِ عَلَى ثَلاَثٍ، وَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يُسَلِّمَ
তোমাদের কারো যদি নামাযের মধ্যে সন্দেহ হয় ফলে সে জানে না যে এক রাকাত পড়ল না কি দুই রাকাত। তাহলে সে যেন এক রাকাত ধরে নিয়ে নামায পড়ে। আর যদি দুই রাকাত পড়ল না তিন রাকাত, তা না জানে তাহলে যেন দুই রাকাত ধরে নামায পড়ে এবং (এসব ক্ষেত্রে) সালাম ফেরানোর পূর্বে দুটি সিজদা আদায় করে। (অর্থাৎ সাহু সিজদা করে)
-জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৯৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/৯৩-৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৩০; কিতাবুল আছল ১/১৯৮; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪০৪; আলবাহরুর রায়েক ২/১১১
আমরা শুনেছি, যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রতি ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক একবার পড়া ওয়াজিব এবং একের অধিক পড়া সুন্নত। এটা কি সঠিক?
যিলহজ্বের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের সালামের পর কোনো কথা বলার আগেই একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। পুরুষরা হালকা আওয়াজে পড়বে আর মহিলারা নিম্ন আওয়াজে পড়বে। একের অধিকবার বলা সুন্নত বা মুস্তাহাব নয়। কোনো কোনো কিতাবে তিনবার পড়াকে সুন্নত বলা হলেও বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তা সহীহ নয়।
উল্লেখ্য, এটি হল নামাযের পরে তাকবীরে তাশরীক পড়ার মাসআলা। এমনি তো ঐ দিনগুলোতে যিকির, তাকবীর ও তাহলীল বেশি বেশি পড়া সুন্নত। তবে এটি হল একটি ইনফেরাদি আমল। হাদীস শরীফে আছে,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبُّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ.
‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়।’(মুসনাদে আহমদ ২/৫৭, হাদীস ৫৪৪৬)
-হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী ২৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; মুলতাকাল আবহুর ১/২৬০; রদ্দুল মুহতার ২/১৭৭, ১৭৮ ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৪৮৪
চিঠি বা মেইলে যদি কেউ সালাম লিখে পাঠায় তাহলে আমি উত্তর মনে মনে দিব, নাকি আমাকে সালামের উত্তর লিখে পাঠাতে হবে?
লিখিত সালামের জবাব লিখেও দেওয়া যায় আবার মুখে উচ্চারণ করেও দেওয়া যায়। সুতরাং প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনি চাইলে জবাব লিখেও পাঠাতে পারেন অথবা নিজে নিজে মুখে জবাব দিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে মৌখিক জবাব তাকে শুনিয়ে দেওয়া জরুরি নয় এবং সালামের জবাবের জন্য তাকে পাল্টা উত্তর লেখা কিংবা ফোন করে জানানো কোনোটিই জরুরি নয়। বরং একাকী মুখে জবাব দিয়ে দিলেই হবে।
-ফয়যুল কাদীর ৪/৩১; রদ্দুল মুহতার ৬/৪১৫
একজন মুসলমান হিন্দু এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু টাকা ঋণ নেয়। কিছুদিন পর হিন্দু লোকটি বাড়ি চলে আসে। এখন তার সাথে যোগাযোগ না থাকায় মুসলমান লোকটি পড়েছে বিপাকে। আমার জানার বিষয় হল, ঐ মুসলিম ব্যক্তি ঋণকৃত টাকা হিন্দু লোকটার নামে সদকা বা আল্লাহর রাস্তায় কল্যাণকর কাজে খরচ করলে ঋণমুক্ত হবে কি না?
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির কর্তব্য হল, যথাসম্ভব হিন্দু করযদাতার ঠিকানা বের করে তার হাতে পাওনা টাকা পৌঁছে দিতে চেষ্টা করা। যথাযথ চেষ্টা করেও যদি তার কোনো সন্ধান পাওয়া না যায় তাহলে নিজের দায়মুক্তির নিয়তে টাকাটা গরিব-দুঃখীকে সদকা করে দিবে। এরপর পরবর্তীতে কখনো যদি ঐ হিন্দু করযদাতার সাথে যোগাযোগ হয় এবং সে তার টাকা দাবি করে তাহলে নিজ থেকে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। আর পরিশোধ করে দিলে পূর্বের সদকার সওয়াব মুসলমান ব্যক্তি পাবে।
-আহসানুল ফাতাওয়া ৬/৩৮৯
সেদিন আসরের নামাযে আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব ভুলে তৃতীয় রাকাতে বসে পড়েছেন। কিন্তু কেউ লোকমা দেয়নি। এরপর চতুর্থ রাকাতে ইমাম সাহেব না বসে সোজা দাঁড়িয়ে যান। কেননা তিনি ভেবেছেন, এটি তৃতীয় রাকাত। মুসল্লিরা শেষ বৈঠকে বসে লোকমা দিয়েছেন। কিন্তু ইমাম সাহেব শেষ বৈঠকে আর ফিরে আসেননি। বাধ্য হয়ে মুসল্লিরা বৈঠক ছেড়ে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের অনুসরণ করেন। মাসআলা জানা থাকায় আমি ও কয়েকজন মুসল্লি শেষ বৈঠকে বসে ছিলাম। এরপর ইমাম সাহেব যখন পঞ্চম রাকাতের সিজদা করেছেন তখন আমরা সালাম ফিরিয়েছি। এরপর অবশ্য আমরাও সকলের সাথে সতর্কতাবশত পুনরায় আসরের নামায আদায় করে নিয়েছি। জানার বিষয় হল, আমাদের প্রথম নামায সহীহ হয়েছিল কি না।
উল্লেখ্য, তৃতীয় রাকাতে ইমাম সাহেব বসার কারণে যে সাহু সিজদা ওয়াজিব হয়েছে আমরা তা আদায় করিনি।
নামাযের শেষ বৈঠক ফরয। তা তরক করলে বা ভুলে ছুটে গেলে নামায ফাসেদ হয়ে যায়। প্রশ্নে উল্লেখিত অবস্থায় ইমাম সাহেব শেষ বৈঠক না করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণে এবং পঞ্চম রাকাতের সিজদার আগ পর্যন্ত বৈঠকে ফিরে না আসার কারণে ইমাম-মুক্তাদি সকলের নামায ফাসেদ হয়ে গেছে। যে সকল মুক্তাদি পঞ্চম রাকাতের জন্য দাঁড়ায়নি তাদেরও নামায হয়নি। কারণ ইমামের নামায ফাসেদ হয়ে গেলে মুক্তাদির নামাযও ফাসেদ হয়ে যায়। সুতরাং উল্লেখিত অবস্থায় ইমাম ও সকল মুক্তাদির পুনরায় নাযায পড়ে নেওয়া সঠিক হয়েছে।
-কিতাবুল আছল ১/২৩৯; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪২৭; ফাতহুল কাদীর ১/৪৪৪; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৩২০
অনেক সময় দেখা যায়, কাউকে সালাম দিলে উত্তরই দেয় না। আবার অনেকে উত্তর দিলেও তা শোনা যায় না। শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দেয়। আমার জানার বিষয় হল, সালামের জবাব দেওয়া কী? এবং তা কি জোরে দেওয়া জরুরি, নাকি আস্তে দিলেও হবে?
সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। জবাব না দিলে ওয়াজিব লঙ্ঘনের গুনাহ হবে। আর সালাম প্রদানকারীকে জবাব শুনিয়ে দেওয়াও ওয়াজিব। তবে যদি দূরত্ব অথবা অন্য কোনো কারণে শুনিয়ে জবাব দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে জবাবের বাক্য উচ্চারণের পাশাপাশি হাত দ্বারা ইশারা করা যাবে এবং এর দ্বারা জবাব দেওয়ার হক আদায় হয়ে যাবে।
-তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৮০৬; তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ ৪/১৯৬; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ১/৪৬৭; আলআযকার ৪০২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৩৩; আলইখতিয়ার ৪/১৪৩; রদ্দুল মুহতার ১/১১৩
আমাদের বাজারে এক হিন্দু দোকানী আছে। কিছুদিন পরপর তার সাথে দেখা হয়। তখন মুসাফাহা করার জন্য সে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি কখনো তার সাথে মুসাফাহা করি আবার কখনো করি না। জানার বিষয় হল, অমুসলিমদের সাথে মুসাফাহা করা বৈধ কি না?
মুসাফাহা কেবল মুসলমানদের সাক্ষাতের সময়ের অভিবাদনের জন্য নির্ধারিত। এর দ্বারা পরস্পরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ فَتَصَافَحَا، وَحَمِدَا اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ، وَاسْتَغْفَرَاهُ غُفِرَ لَهُمَ.
যখন দু’জন মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক সাক্ষাৎ হয় এবং তারা মুসাফাহা করে আর তার সাথে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৬৯
তাই অমুসলিমদের সাথে মুসাফাহা হয় না। তাদের সাথে মুসাফাহার প্রচলন করা ঠিক নয়।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬২৩৯-২৬২৪২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৪৮; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৩৪; রদ্দুল মুহতার ৬/৪১২
আমাদের এলাকার একটি গ্রাম্য জামে মসজিদের টাকা অগ্রিম দিয়ে অদূরে একটি ব্রিক ফিল্ডের সাথে বিগত কয়েক বছর থেকে লাভজনক হারে দাদন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে ব্রিক ফিল্ডের মালিক উক্ত মসজিদকে নির্দিষ্ট সিজনে যে পরিমাণ ইট সরবরাহ করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয় তা মসজিদের পক্ষ হতে পাবলিকের নিকট লাভজনক হারে বিক্রি করে টাকা নিজ হাতে মসজিদের অনুমতিতে রেখে দেয়। মসজিদ পক্ষ পুনরায় আরো কিছু টাকা ব্রিক ফিল্ডের মালিকের নিকট দিয়ে উক্ত কার্যক্রমের নবায়ণ করে।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল, উক্ত গৃহীত পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তে বৈধ হয়েছে কি না? যদি উক্ত ব্যবস্থা শরীয়ত পরিপন্থী হয়ে থাকে তাহলে সঠিক নিয়ম বিস্তারিত দলিলসহ জানালে উপকৃত হব।
প্রশ্নের বর্ণনা অনুযায়ী ব্রিক ফিল্ডের মালিকের সাথে উক্ত লেনদেন নাজায়েয হয়েছে। কারণ বাইয়ে সালাম তথা আগাম বিক্রিতে পণ্য আদায়ের সময় হলে পণ্য হস্তগত বা বুঝে নেওয়া জরুরি। পণ্য বুঝে নেওয়ার পূর্বে উক্ত বিক্রি চুক্তি সম্পন্নই হয় না। তাই পণ্য বুঝে নেওয়ার আগে ঐ পণ্য অন্যত্র বিক্রি করা বা বিক্রেতাকেই বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া সবই নাজায়েয। হাদীস শরীফে এসেছে, হাকিম বিন হিযাম রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি বিভিন্ন জিনিষ ক্রয় করে থাকি। তো কোন জিনিস আমার জন্য বৈধ আর কোন জিনিস অবৈধ? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
يَا بْنَ أَخِي، إِذَا ابْتَعْتَ بَيْعًا فَلَا تَبِعْهُ حَتَّى تَقْبِضَهُ.
‘হে আমার ভাতিজা! যখন কোনো কিছু ক্রয় করবে তখন ক্রয়কৃত বস্তু বুঝে নেওয়ার পূর্বে তা বিক্রি করবে না।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৯৯০
উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
إِذَا أَسْلَمْتَ فِي شَيْءٍ فَلَا تَبِعْهُ حَتَّى تَقْبِضَهُ.
‘তুমি কোনো কিছুতে সালাম চুক্তি করলে ঐ বস্তু বুঝে নেওয়ার পূর্বে তা বিক্রি করো না।’ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২১২৪৪
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকেও তাই বর্ণিত হয়েছে। -প্রাগুক্ত, ২১২৪৫
সুতরাং প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে মসজিদ কমিটির ইট বুঝে নেওয়া ছাড়াই অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয হয়েছে। বরং প্রথম ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন হওয়া ছাড়াই লাভ নেওয়ার কারণে অনেকটা এমনই হয়ে গেল যে, মসজিদ কমিটি ব্রিক ফিল্ড কর্তৃপক্ষকে অল্প টাকা দিয়ে ইট ক্রয়ের নামে মেয়াদান্তে বেশি টাকা গ্রহণ করল। অথচ ইট ক্রয়ই সম্পন্ন হয়নি। ফলে এ কারবার অনেকটা সুদি কারবারের সাথেই মিলে গেছে।
এছাড়া প্রশ্নোক্ত লেনদেনে আগাম বিক্রিচুক্তির সাথে উক্ত পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার চুক্তিও যুক্ত আছে। আর এভাবে এক চুক্তির সাথে অন্য চুক্তিকে শর্ত করাও নাজায়েয। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
প্রশ্নোক্ত লেনদেনটি যেহেতু নাজায়েয হয়েছে তাই এর লাভ মসজিদের কাজে লাগানো যাবে না। তা সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বৈধভাবে লেনদেন করতে চাইলে মসজিদ কর্তৃপক্ষ প্রথমে ব্রিক ফিল্ডের মালিকের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইট নির্ধারিত তারিখে নেওয়ার চুক্তি করবে। এ সময় ব্রিক ফিল্ড কর্তৃপক্ষকে ইট পুনরায় অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়ার দায়িত্ব দিবে না; বরং এ সময় শুধু আগাম বিক্রি চুক্তিই করবে। পরে যখন মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে তখন মসজিদ কর্তৃপক্ষ ইটগুলো বুঝে নিবে এবং তারাই অন্যত্র বিক্রি করে দিবে। আর নিজেদের পক্ষে তা বিক্রি করা সম্ভব না হলে তখন ব্রিক ফিল্ড কর্তৃপক্ষকে বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া যাবে। কিন্তু এ দায়িত্ব দিতে হবে নিজেদের ইট অন্যান্য ইট থেকে পৃথক করা ও বুঝে নেওয়ার পর। ব্রিক ফিল্ড কর্তৃপক্ষ ইট অন্যত্র বিক্রি করে টাকা মসজিদ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করবে।
উল্লেখ্য যে, আগাম বিক্রি তথা বাইয়ে সালাম সহীহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যথা : ১. চুক্তির সময় পণ্যের পরিমাণ নির্ধারিত করা ২. পণ্যের গুণগত মান নির্ধারিত করা ৩. মূল্য বাকি না থাকা; বরং চুক্তির সময়ই সমস্ত মূল্য পরিশোধ করে দেওয়া ৪. পণ্য যদি এমন হয়, যা বহন করতে খরচের প্রয়োজন হয় যেমন, ইট ইত্যাদি তাহলে তা ক্রেতাকে কোথায় বুঝিয়ে দিবে তা নির্ধারিত করা ৫. পণ্য আদায়ের সময়সীমা নির্ধারিত করা এবং সে অনুযায়ী তা হস্তগত করা ইত্যাদি। আর এসব বিষয় উভয় পক্ষের স্বাক্ষরের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। যাতে পরবর্তীতে এসব বিষয়ে কোনো বিবাদ না হয়।
প্রকাশ থাকে যে, মসজিদের দানের টাকা দাতাগণ সরাসরি মসজিদ ও সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার করার জন্যই দিয়ে থাকে। মসজিদের দানের টাকা দিয়ে ব্যবসা করার প্রচলন আমাদের সমাজে নেই। এছাড়া বর্তমানে আমানতদারির খুব অভাব। এমন পরিস্থিতিতে মসজিদের সাধারণ দানের টাকা দিয়ে ব্যবসা না করাই কর্তব্য। ব্যবসা করতে চাইলে ব্যবসার জন্য আলাদা ফান্ড গঠন করে সে টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে। আর মসজিদের টাকা এমন খাতে বিনিয়োগ করবে যাতে ঝুঁকির পরিমাণ কম থাকে।
-সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৯৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২১২৪৪; আলবাহরুর রায়েক ৬/১৬৪, ৬/১১৭; ফাতাওয়া খানিয়া ২/২৬২; শরহুল মাজাল্লা, খালিদ আতাসী ২/১৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৭৮৩; রদ্দুল মুহতার ১/৬৫৮
ক. কোন ব্যক্তি যদি ঈদের নামাযে প্রথম তিন তাকবির শেষ হওয়ার পর কেরাত অবস্থায় নামাযে শরীক হয় তাহলে তার তাকবীরের হুকুম কী?
খ. কোন ব্যক্তি যদি ঈদের নামাযের প্রথম বা দ্বিতীয় রাকাতের রুকুর মধ্যে শরীক হয় তাহলে সে তাকবীর কখন বলবে?
গ. কোন ব্যক্তি ঈদের নামাযে দ্বিতীয় রাকাতে কেরাত অবস্থায় শরীক হলে তার তাকবীরের হুকুম কী?
ঘ. আর কেউ যদি ঈদের নামাযে ইমাম সাহেবকে শেষ বৈঠকে পায় তাহলে তার তাকবীরের হুকুম কি?
দয়া করে জানারে উপকৃত হব।
ক. ঈদের নামাযে কোন ব্যক্তি যদি ইমামের সাথে প্রথম রাকাতে অতিরিক্ত তাকবীর না পায় বরং কিরাত অবস্থায় নামাযে শরীক হয় তাহলে সে তাকবীরে তাহরীমার পর নিজে নিজে অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলে নিবে। -ফাতাওয়া তাতরখানিয়া ২/৬১৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫১
খ. ঈদের নামাযে ইমামকে প্রথম বা দ্বিতীয় রাকাতের রুকুর মধ্যে পেলে যদি তার প্রবল ধারণা হয় যে, দাঁড়ানো অবস্থায় অতিরিক্ত তাকবীর বলে সে ইমামের সাথে রুকুতে শরীক হতে পারবে, তাহলে তাকবীরে তাহরীমার পর দাঁড়ানো অবস্থায়ই অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলে রুকুতে ইমামের সাথে শরীক হবে। আর যদি দাঁড়িয়ে তাকবীর বললে ইমামকে রুকুতে না পাওয়ার প্রবল ধারণা হয় তাহলে তাকবীরে তাহরীমার পর রুকুতে চলে যাবে। এবং রুকুতেই হাত উঠানো ছাড়া অতিরিক্ত তাকবীরগুরো বলে নিবে। এ ক্ষেত্রে রুকুর তাসবীহ না বললেও চলবে।
প্রকাশ থাকে যে, রুকুতে ইমামের সাথে শরীক হওয়ার পর অতিরিক্ত তাকবীর বলার মত সময় না পেলে সে ক্ষেত্রে আর তাকবীর বলতে হবে না। ইমামের সাথে রুকু পাওয়ার কারণে সে ঐ রাকাত পেয়েছে এবং সাথে সাথে তাকবীরও পেয়েছে বলে ধর্তব্য হবে। -ফাতওয়া তাতরখানিয়া ২/৬১৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫১
গ. ইমামকে দ্বিতীয় রাকাতের কেরাত অবস্থায় পেলে যথারীতি ইমামের সাথে শরীক হয়ে যাবে। এবং ইমাম যখন রুকুর আগে অতিরিক্ত তাকবীর বলবে সেও ইমামের সাথে তাকবীর বলবে। আর ইমামের সালাম ফিরানোর পর ছুটে যাওয়া রাকাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে প্রথমে সূরা-কেরাত পড়বে তারপর রুকুর আগে অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলবে। -ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২/৬১৯, ৬২১; আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৪
ঘ. যে ব্যক্তি ঈদের নামাযে শেষ বৈঠকে শরীক হবে তার কর্তব্য হল, সালাম ফিরানোর পর দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই উভয় রাকাত আদায় করবে। অর্থাৎ প্রথম রাকাতের জন্য দাঁড়িয়েই কিরাতের পূর্বে অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলবে। আর দ্বিতীয় রাকাতে কিরাতের পর অতিরিক্ত তাকবীর বলবে। -ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৮৫
কোনো ব্যক্তি ঈদের নামাযে ইমাম সাহেবকে দ্বিতীয় রাকাতে পেলে সে ইমাম সাহেবের সালাম ফেরানোর পর প্রথম রাকাত আদায়ের সময় অতিরিক্ত তাকবীরগুলো কখন বলবে?
ঐ ব্যক্তি ছুটে যাওয়া রাকাত আদায়ের সময় রুকুর আগে অতিরিক্ত তিন তাকবীর বলবে। প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযে এক রাকাতের মাসবূক হয়েছে সে যে রাকাত পেয়েছ তাতে ইমামের সাথে তাকবীর বলবে। আর যে রাকাত পায়নি তাতে ইমাম সাহেবের দ্বিতীয় রাকাতের ন্যায় (অর্থাৎ রুকুর আগে) অতিরিক্ত তাকবীরগুলো বলবে।
Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৫৮৬৩; মাবসূত, সারাখসী ২/৪০; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৪৯৪; আলবাহরুর রায়েক ২/১৬১; আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৪
মাসবুক ব্যক্তি ইমামের সালাম ফিরানোর পর কখন দাঁড়াবে? অনেকে দেখা যায় প্রথম সালামের পর দাঁড়িয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, দ্বিতীয় সালামের পর দাঁড়াতে হবে। কোনটি সঠিক।
সঠিক নিয়ম হল, ইমাম সাহেবের উভয় দিকে সালাম ফিরানোর পর মাসবুক তার অবশিষ্ট নামায আদায়ের জন্য দাঁড়াবে। ইমামের প্রথম সালামের পরই দাঁড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ ইমাম সাহু সিজদা দিলে মাসবুকেরও ইমামের সাথে সিজদা করা আবশ্যক। আর ইমামের সাহু সিজদা নেই এটা প্রায় নিশ্চিত হবে দ্বিতীয় সালামের পর। তাই দ্বিতীয় সালামের পরই মাসবুক দাঁড়াবে।
Ñমুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৩১৫৫; আলবাহরুর রায়েক ১/৩৭৮; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/১০৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৯১; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৯৭
আমি আসরের নামাযে মাসবুক হই। শেষ বৈঠকে ইমাম সাহেবের সালাম শুনে অবশিষ্ট নামায আদায় করতে দাঁড়িয়ে যাই। পরে ইমাম সাহেবের তাকবীর শুনে বুঝতে পারি ইমাম সাহেব সাহু সিজদা করছেন। তখন আমি সাথে সাথে বসে যাই এবং ইমামের সাথে সাহু সিজদা আদায় করি। এরপর যথানিয়মে অবশিষ্ট নামায পড়ি। এখন জানার বিষয় হল, আমার ঐ নামায কি আদায় হয়েছে?
হাঁ, আপনার ঐ নামায সহীহ হয়েছে। দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর সাহু সিজদার তাকবীর শুনে সাথে সাথে বসে যাওয়া এবং ইমামের সাথে সাহু সিজদায় শরিক হওয়া ঠিকই হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, মাসবুকের জন্য ইমাম উভয় সালাম ফেরানোর পর দাঁড়ানো উচিত। যাতে করে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ইমামের নামায সমাপ্ত হয়েছে এবং তার উপর সাহু সিজদা নেই।
Ñফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৯২; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/১০২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ১/৫৯৭; শরহুল মুনয়া পৃ. ৪৬৬
নামাযে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হওয়ার পর কখনো আমি সিজদায়ে সাহু করতে ভুলে যাই এবং সালাম ফিরিয়ে ফেলি। সালাম ফিরানোর পর মনে পড়ে। এ অবস্থায় আমার করণীয় কি?
সাহু সিজদা ওয়াজিব হওয়ার পর ভুলবশত সিজদা না করে সালাম ফিরিয়ে ফেললে কর্তব্য হল, সালামের পর নামায পরিপন্থী কোনো কাজ না করে থাকলে সিজদায়ে সাহুর কথা মনে পড়ার সাথে সাথে সিজদা করে নিবে এবং যথানিয়মে তাশাহহুদ দুরূদ ও দুআ মাসূরা পড়ে নামায শেষ করবে। তবে সালাম
ফিরানোর পর নামায পরিপন্থী কোনো কাজ করলে যেমন কথা বলে ফেললে সাহু সিজদা করার সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে আদায়কৃত নামায পুণরায় পড়ে নেওয়া ওয়াজিব হবে।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৪৫১২; কিতাবুল আসল ১/২০০; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৩২৪, ৩২৫; রদ্দুল মুহতার ২/৯১
জানাযা নামাযে সালাম ফিরানোর সময় লক্ষ্য করা যায় যে, অনেকে এক সালামে এক হাত করে দুই সালামে দুই হাত ছেড়ে দেয়। এর সঠিক পদ্ধতি দলিলসহ বর্ণনা করলে উপকৃত হব।
জানাযা নামাযে সালাম ফিরানোর সময় হাত কখন ছাড়বে- এ সম্পর্কে ফিকহবিদগণ থেকে দুই ধরনের মত রয়েছে। একটি মত হল, চতুর্থ তাকবীর বলার পর উভয় হাত ছেড়ে দিবে এবং এরপর সালাম ফিরাবে। আরেকটি মত হল, উভয় সালাম ফিরানো পর্যন্ত হাত বেঁধে রাখবে। সালাম ফিরানোর পর উভয় হাত ছেড়ে দিবে।
সুতরাং জানাযা নামাযে সালাম ফিরানোর সময় উপরোক্ত যে কোনো পদ্ধতিই অবলম্বন করা যেতে পারে।
আর প্রশ্নে যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে তা ঠিক মনে হয় না।
-খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২২৫; আসসিআয়াহ ২/১৫৯; হেদায়া, ফাতহুল কাদীর ১/২৫০; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪৮৭-৪৮৮
গত রমযানে একদিন আমি বিতর নামায পড়াতে গিয়ে ভুলক্রমে দুআয়ে কুনূত না পড়ে রুকুতে চলে যাই। মুসল্লিরা সাথে সাথে পেছন থেকে লোকমা দিলে আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দুআয়ে কুনূত পড়ি এবং নামায শেষে সাহু সিজদা দেই। সালামের পর মুসল্লিদের কেউ কেউ বলল, সাহু সিজদা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমাদের দুআয়ে কুনূত ছুটেনি এবং রুকুতে গিয়েও তিন তাসবীহ পরিমাণ বিলম্ব হয়নি। হুজুরের কাছে জানতে চাই, তাদের কথা কি ঠিক? আমার জন্য কি সিজদায়ে সাহু করা ঠিক হয়েছে?
প্রশ্নোক্তক্ষেত্রে আপনার জন্য সিজদায়ে সাহু করা ঠিকই হয়েছে। সিজদায়ে সাহুর প্রয়োজন ছিল না- প্রশ্নের এ কথা ঠিক নয়। কেননা দুআয়ে কুনূত না পড়ে রুকুতে চলে যাওয়ার কারণেই সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়ে গেছে। তাই রুকু থেকে উঠে দুআ কুনূত পড়লেও সাহু সিজদা দিতে হবে। রুকুতে তিন তাসবীহ বিলম্ব হয়েছে কি না তা এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় নয়। কুনূত না পড়ে রুকুতে চলে গেলে নিয়ম হল, কুনূতের জন্য আর না দাঁড়ানো। তাই এক্ষেত্রে মুক্তাদিগণ ইমামকে দাঁড়াতে বাধ্য করবে না। বরং যথানিয়মে অবশিষ্ট নামায পূর্ণ করে শেষে সিজদায়ে সাহু করবে।
-বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১১১; আলবাহরুর রায়েক ২/৪২; রদ্দুল মুহতার ২/৯-১০
আমি এক মসজিদের ইমাম। ফজর ও আসরের নামাযের সালাম ফিরানোর পর কখনো দেখি, আমার বরাবর পেছনের কাতারে মাসবুক ব্যক্তি নামায পড়ছে। এ অবস্থায় আমার জন্য মুসল্লিদের দিকে মুখ করে বসা জায়েয হবে কি না?
মাসবুক যদি দ্বিতীয় কাতারে বা আরো পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে আর তার সামনে কেউ থাকে তবে ইমাম ঐ বরাবর মুখ করে বসতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু মাসবুকের সামনে কোনো আড়াল না থাকলে তার বরাবর মুখ করে বসা মাকরূহ
হবে। কেননা নামাযির সামনে কোনো আড়াল না থাকলে তার বরাবর মুখ করে বসা বা দাঁড়ানো মাকরূহ তাহরীমী।
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১১; হালবাতুল মুজাল্লী ২/২২৩; শরহুল মুনইয়াহ ৩৪১; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী ১৭১-১৭২
শেষ বৈঠকে মুকতাদীর দরূদ শরীফ বা দুআ মাসূর শেষ হওয়ার আগেই যদি ইমাম সাহেব সালাম ফিরায় তাহলে মুকতাদীর করণীয় কী? দুআ-দরূদ শেষ করে সালাম ফিরাবে নাকি শেষ করার পূর্বেই ইমামের সাথে সালাম ফিরাবে?
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে মুকতাদীর দরূদ শরীফ ও দুআ মাসূর শেষ না হলেও ইমাম সাহেবের সাথে সালাম ফিরাবে। কেননা, দরূদ শরীফ ও দুআ মাসূর পড়া সুন্নত আর ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তবে ইমাম সাহেবের উচিত একটু ধীর গতিতে পড়া যাতে মুসল্লিরা দরূদ শরীফ ও দুআ মাসূর শেষ করতে পারে।
-ফাতাওয়া খানিয়া ১/৯৬; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১৫৯; শরহুল মুনইয়াহ ৫২৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৯০
একবার ফরয নামায আদায় করার পর পুণরায় জামাতে ঐ ফরয নামায আদায় করা যাবে কি?
প্রতিটি ফরয নামায তার নির্দিষ্ট ওয়াক্তে একবারই ফরয। একবার আদায় করার পর ঐ ওয়াক্তে আবার আদায় করলে তা নফল গণ্য হবে।
তাই যোহর ও ইশার নামায আদায় করার পর নফলের নিয়তে জামাতের সাথে আবার পড়তে পারবে।
তবে ফজর ও আসরের ফরয আদায়ের পর নফলের নিয়তেও দ্বিতীয়বার পড়া যাবে না। কেননা ফজর ও আসরের পর নফল পড়া মাকরূহ। আর মাগরিবের পর যদিও নফল পড়া যায় কিন্তু তিন রাকাত নফল নেই। তাই ইমামের পিছনে নফলের নিয়তে মাগরিবে শরিক না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। একান্ত শরিক হলে ইমামের সালামের পর আরো এক রাকাত একাকী পড়ে নিতে হবে।
-আলবাহরুর রায়েক ২/৭২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৫; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ২/৫১৯
ক) স্মরণশক্তি কেন বাড়ে কেন কমে (লেখক : মুফতী মুহাম্মাদ মুজীবুল হক) -এর ২৫ পৃষ্ঠায় স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ১টি কারণ উল্লেখ করেছেন যে, অতিরিক্ত পানি পান করা। কারণ অতিরিক্ত পানি কফ তৈরি করে। আর তার প্রভাব পড়ে স্মরণ শক্তির উপর। প্রায় সত্তরজন নবী এ মর্মে একমত হয়েছেন যে, অধিক বিস্মৃতি অধিক কফের কারণে হয়। আর অধিক কফ অধিক পানি পান করার কারণে হয়। আর অধিক পানি পান করতে হয় অধিক খাবার গ্রহণ করার কারণে। হুজুরের নিকট এ বিষয়ের তাহকীক জানতে চাই।
খ) লোকমুখে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, হাজরে আসওয়াদ প্রথমে সাদা বর্ণের ছিল। পরবর্তীতে লোকদের চুম্বনে তাদের গুনাহ চুষে কালো হয়ে গেছে। এ বিষয়ের বাস্তবতা কি? জানতে চাই।
গ) লোকমুখে আরেকটি কথা প্রচলিত আছে যে, ঘরে মাকড়সার জাল থাকলে অভাব অনটন দেখা দেয়। জানার বিষয় হল, কথাটার বাস্তবতা কী? মাকড়সা মারার হুকুম কি?
ক) পরিমিত পানি শরীরের জন্য দরকারি এবং উপকারী। তাই দৈনিক কী পরিমাণ পানি পান স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন তা অভিজ্ঞ ডাক্তার থেকে জেনে নিবে।
আর প্রয়োজনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত পানি পান চিকিৎসাবিদদের ভাষ্যমতে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। এজন্য তারা মাত্রাতিরিক্ত পানি পানের পরামর্শও দেন না।
আর প্রশ্নে সত্তরজন নবী থেকে যে কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতিরিক্ত পানি পান প্রকারান্তরে অধিক বিস্মৃতির কারণ এটি ভিত্তিহীন। এ ধরনের কোনো কথা কুরআন-হাদীসে নেই।
এ ধরনের একটি কথা তালীমুল মুতাআল্লিম কিতাবের হিন্দুস্তানী কপিতে পাওয়া যায়। যা সম্ভবত পাণ্ডুলিপিকারদের ভুলের কারণেই ঘটেছে। মূলত সঠিক বক্তব্য হল, اتفق سبعون طبيبا যার অর্থ হল, সত্তরজন চিকিৎসক একমত হয়েছেন। এ বক্তব্যে طبيبا শব্দটির স্থানে ঐ কপিতে نبيا এসে গেছে। যার ফলে অর্থ দাঁড়িয়েছে সত্তরজন নবী একমত হয়েছেন।
আমরা তালীমুল মুতাআল্লিমের দুটি তাহকীকী নুসখা দেখেছি। একটি হল বৈরুতের আলমাকতাবুল ইসলামী-এর নুসখা, যা ডক্টর মারওয়ান কুববানীর তাহকীককৃত। এ নুসখার ৯৭ নং পৃষ্ঠায় উক্ত বক্তব্য এভাবে আছে-
اتفق سبعون طبيبا
আরেকটি সুদানের ‘আদদারুস সুদানিয়া লিল কুতুব’-এর নুসখা। এর প্রথম সংস্করণ ১৪২৫ হিজরী, ২০০৪ ঈসায়ী। এ সংস্করণের ৪৬ পৃষ্ঠাতেও اتفق سبعون طبيبا -ই আছে।
বাকি থাকল কেন সত্তরজন চিকিৎসক এ বিষয়ে একমত হয়েছেন? প্রয়োজনে সেটিও একটি তাহকীকের বিষয়। এবং প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানে কথাটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য ছিল এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি কতটুকু বাস্তবসম্মত- এসবই তাহকীকযোগ্য। যে কথা স্পষ্ট থাকা দরকার তা হল, নবীদের দিকে উক্ত কথাটিকে সম্বন্ধ করা ভিত্তিহীন। আর যে পরিমাণ পানি শরীরের জন্য প্রয়োজন তা স্মৃতি কমানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না এটিই স্বাভাবিক।
উত্তর : খ) প্রশ্নোক্ত কথাটি সঠিক। হাজরে আসওয়াদ প্রথমে সাদা ধবধবে ছিল। অতপর চুম্বনকারী এবং ইস্তেলামকারীর গুনাহসমূহের প্রভাবে তা কালো হয়ে যায়।
হাদীস শরীফে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে এসেছে। এটি দুধের চেয়েও অধিক শুভ্র ছিল। অতপর আদম সন্তানের গুনাহসমূহ এটিকে কালো করে দিয়েছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৮৭৭; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৩৩
উত্তর : গ) মাকড়সার জাল ঘরে থাকলে অভাব-অনটন দেখা দেয়- প্রশ্নের এ কথাটি অবাস্তব। কুরআন-হাদীসে এর কোনো প্রমাণ নেই। কোনো কোনো তাফসীরের কিতাবে আলী রা. থেকে এ ধরনের একটি কথা উল্লেখ আছে বলে পাওয়া যায়। কিন্তু এর সনদ মুনকার, সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। তাই মাকড়সার জাল এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা থেকে ঘর-বাড়িকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যে কর্তব্য তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর মাকড়সা মারার ক্ষেত্রে হুকুম হল, মাকড়সা যদি ক্ষতিকর বা বিষাক্ত প্রকৃতির হয় তবে তা মেরে ফেলা জায়েয। কিন্তু যদি তা ক্ষতিকর না হয় সেক্ষেত্রে না মেরে বাসা-বাড়ি থেকে তা ঝেড়ে ফেলে দেয়াই শ্রেয়।
-ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৬১; আদ্দুররুল মুখতরা ৬/৪৭৪; আলমাওসুআতুল ফিকহিয়া, কুয়েত ১৭/২৮৪; ইমদাদুল আহকাম ৪/৫১৯
কখনো কখনো আমি মাসবুক হই। কিন্তু ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর যখন বাকি নামায আদায় করতে দাঁড়াই তখন কখনো কখনো মনে থাকে না যে, ইমামের সাথে কয় রাকাত পেয়েছি আর কয় রাকাত ছুটেছে। সেক্ষেত্রে আমার পাশের ব্যক্তি যে আমার সাথেই নামাযে শরিক হয়েছে তাকে দেখে নামায আদায় করি। জানার বিষয় হল, এভাবে নামায আদায় করলেও কি নামায হয়ে যায়?
হাঁ, নিজের ছুটে যাওয়া রাকাতের (সংখ্যা) স্মরণ না থাকলে পাশের মুসল্লির নামাযের প্রতি খেয়াল করে নিজে নিজে সে অনুযায়ী নামায পড়লেও হয়ে যাবে। তবে নামায একাগ্রতার সাথে আদায় করা উচিত। বারবার এমনটি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।
-ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ১/৫৯; আলবাহরুর রায়েক ১/৩৭৮; রদ্দুল মুহতার ১/৫৯৭; ফাতাওয়া খানিয়া ১/১০৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৯২
কখনো আমি নামাযে মাসবুক হই। নামায শেষে ভুলক্রমে ইমামের সাথে সালাম ফিরিয়ে ফেলি। পরে অন্যদের দেখে মনে হয়। জানতে চাই, এক্ষেত্রে কি আমার নামায ভেঙ্গে যাবে? নামায না ভাঙ্গলে কি আমার উপর সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে?
এক্ষেত্রে ভুলক্রমে ইমামের সাথে সালাম ফিরানোর কারণে নামায ভঙ্গ হবে না। তবে এ অবস্থায় দেখতে হবে যদি আপনার সালাম ইমামের সালামের সাথেই হয় তাহলে সিজদায়ে সাহু করতে হবে না। আর যদি আপনার সালাম ইমামের সালামের পরে হয় তাহলে অবশিষ্ট নামায শেষে আপনাকে সিজদায়ে সাহু করে নিতে হবে।
-বাদায়েউস সানায়ে ১/৪২২; ফাতহুল কাদীর ১/৩৩৯; শরহুল মুনইয়াহ ৪৬৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৯১; রদ্দুল মুহতার ১/৫৯৯
ফজরের নামাযের জামাত শুরু হওয়ার পর কোনো মুসল্লি যদি মসজিদে এসে বারান্দায় অথবা মসজিদের পেছনের দিকে ফজরের সুন্নত নামায পড়তে চান তা কি তার জন্য জায়েয হবে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে মাসআলাটি জানার আগ্রহ প্রকাশ করছি। এ ব্যাপারে কোনো কোনো ব্যক্তি মত প্রকাশ করে থাকেন যে, ‘‘ফরয নামাযের জন্য ইকামত দেওয়া হয়ে গেলে অন্য কোনো নামায বা সুন্নত নামায (বিশেষ করে ফজরের সুন্নত) সম্পূর্ণ হারাম, সুন্নত বিরোধী।’’এ সম্পর্কে তারা একটি লিফলেট প্রচার করে থাকে। যাতে তাদের স্বপক্ষে কয়েকটি হাদীসও উল্লেখ আছে। উক্ত লিফলেটটি প্রশ্নের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হল।
কোন ব্যক্তি যদি ফজরের ইকামত চলাবস্থায় বা জামাত চলাবস্থায় মসজিদে আসে আর তার কাছে মনে হয় যে সুন্নত পড়ে অন্তত এক রাকাত পাওয়া যাবে তাহলে এ ব্যক্তির জন্য মূল জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা খুঁটির আড়ালে ফজরের সুন্নত আদায় করা জায়েয আছে।
একাধিক সাহাবা তাবেয়ীন থেকে ইকামত শুরু হওয়ার পর জামাত চলাবস্থায় ফজরের সুন্নত আদায় করা প্রমাণিত আছে। যেমন:
এক. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু মুসা আশআরী ও হুযায়ফা রা. একবার সাঈদ ইবনে আসের নিকট থেকে বের হলেন। ইতিমধ্যে ফজর নামাযের ইকামত হয়ে গেল। তখন ইবনে মাসউদ রা. দু’রাকাত সুন্নত পড়ে লোকদের সাথে নামাযে শরীক হলেন, আর আবু মুসা আশআরী ও হুযায়ফা রা. কাতারে প্রবেশ করলেন। (শরহু মাআনীল আসার,১/২৫৫)
দুই. আবু মিজলায রাহ. বলেন আমি ফজর নামাযে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সাথে মসজিদে এমন সময় প্রবেশ করলাম যে ইমাম নামায পড়াচ্ছিলেন, তখন ইবনে আব্বাস রা. দু’রাকাত সুন্নত পড়ে ইমামের সাথে শরীক হলেন। আর ইবনে ওমর রা. ইমামের সাথে নামাযে শরীক হয়ে গেলেন। ইমাম সালাম ফেরানোর পর তিনি সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকলেন অতপর উঠে দুরাকাত নামায আদায় করলেন। (প্রাগুক্ত ১/২৫৫)
তিন. আবু দারদা রা. বলেন আমি একদা লোকদের নিকট এমন সময় আসি যে তারা কাতারবদ্ধ হয়ে ফজর নামায আদায় করছিল। আমি তখন ফজরের দু’রাকাত সুন্নত আদায় করি অতপর তাদের সাথে নামাযে শরীক হই। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৬৪৮২
চার. নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ইবনে ওমর রা. একদা ফজর নামাযের জন্য পোশাক পরিধান করছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি ইকামত শুনতে পেলেন, তিনি তখন কামরাতে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত আদায় করলেন অতপর বের হয়ে লোকদের সাথে ফরয আদায় করলেন। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৪০১৯
পাঁচ. আবু উসমান নাহদী রাহ. বলেন আমরা ওমর রা.-এর নিকট ফজরের সুন্নত না পড়ে এসে যদি দেখতাম যে তিনি ফজরের জামাতে আছেন তাহলে আমরা মসজিদের শেষ দিকে এসে সুন্নত পড়ে নিতাম অতপর জামাতে শরীক হতাম। -শরহু মাআনীল আছার ১/২৫৬
ছয়. বিখ্যাত তাবেয়ী মাসরূক রাহ. মসজিদে প্রবেশ করলেন, তখন লোকেরা ফজর নামায পড়ছিল,তিনি এক কোনায় ফজরের দুই রাকাত সুন্নত আদায় করেন অতপর জামাতে শরীক হন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৬৪৭২
সাত. মুজাহিদ রাহ. বলেন, যখন তুমি মসজিদে এসে লোকদেরকে ফজরের জামাতে দেখতে পাবে,আর তুমি ফজরের সুন্নত পড়নি তাহলে তুমি তা পড়ে নাও যদিও তোমার প্রথম রাকাত ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৬৪৭৯
তাবেয়ীদের মধ্যে আরো যাদের থেকে ফজরের জামাত চলাবস্থায় সুন্নত পড়া প্রমাণিত আছে তারা হলেন, সাঈদ ইবনে জুবাইর, হাসান বসরী, ইকরিমা, ইবরাহীম নাখায়ী রহ.। ইবনে বাত্তাল রহ. উমর রা. এর আমলও এমন ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
কোনো কোনো সাহাবী, তাবেয়ী ইকামত বা জামাত চলাবস্থায় মসজিদের অভ্যন্তরে ফজরের সুন্নত না পড়লেও মসজিদের বাহিরে বা মসজিদের দরজা সংলগ্ন স্থানে পড়ে নিতেন। তন্মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা., হাম্মাদ, আব্দুর রহমান ইবনে মা‘কিল, আতা, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. উল্লেখযোগ্য।
উপরোক্ত সাহাবা, তাবেয়ীদের আছার, আমল ও ঘটনাবলী থেকে একথা সুপ্রমাণিত যে, ফজরের ইকামত চলার সময় বা ইকামতের পরও মসজিদের বাহিরে বা কাতার থেকে দূরে মসজিদের বারান্দায় বা কোনায় কিংবা খুঁটির আড়ালে ফজরের সুন্œত পড়া জায়েয আছে। মহান পূর্বসুরী এ সকল সাহাবা, তাবেয়ীদের বক্তব্য ও আমল থাকা সত্তে¡ও হাদীসের মর্ম ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না বুঝে ফজরের সুন্নত পড়াকে নাজায়েয, হারাম বা বিদআত বলা বড় অন্যায়। এমন কথা প্রকারান্তরে সাহাবা-তাবেয়ীদের আমলকেও বিদআত ও হারাম বলার নামান্তর।
এ কথা সত্য যে, কিছু সংখ্যক সাহাবা إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইকামত শুরু হওয়ার পর ফজরের সুন্নত পড়তেন না; বরং জামাতে শরীক হয়ে যেতেন। যেমন, আবু হুরায়রা রা., হুযায়ফা রা. তাবেয়ীদের মধ্যে ইবনে সীরীন, ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীরসহ আরো প্রমুখ। কিন্তু যে সকল সাহাবা, তাবেয়ীন ইকামত অবস্থায় বা পরে মসজিদে বা মসজিদের বাহিরে ফজরের সুন্নত পড়েছেন তাদেরকে তারা কোনোরূপ তিরস্কার করেননি। যেমন পূর্বে উল্লেখিত ইবনে মাসউদ, আবু মুসা আশআরী ও হুযায়ফা রা.-এর ঘটনা এবং আবু মিজলাযের বর্ণনায় ইবনে ওমর ও ইবনে আব্বাসের ঘটনা এবং আবু উসমান নাহদীর বর্ণনায় ওমর রা.-এর ঘটনা। এ সময় ফজরের সুন্নত পড়া যদি নাজায়েয, হারাম বা বিদআতই হত তাহলে সাহাবা কেরাম অবশ্যই এমন নাজায়েয ও হারাম কাজ করতে বাধা দিতেন। কেননা সাহাবা কেরাম কোনো নাজায়েয বা হারাম কাজকে কিছুতেই বরদাশত করতেন না।
মূলত এ মাসআলায় শুরু থেকেই সাহাবা তাবেয়ীনের মাঝে দুধরনের মত ও আমল চালু ছিল। তাদের এক জামাত إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইকামত শুরু হওয়ার পর কোন নামাযের পূর্বে সুন্নত পড়তেন না। এমনকি ফজরের সুন্নতও না।
পক্ষান্তরে অনেক সাহাবা ও তাবেয়ীন ফজরের সুন্নত অন্য সকল সুন্নত অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে এবং বিভিন্ন দিক থেকে ফজরের সুন্নত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ার কারণে তারা ইকামত শুরু হওয়ার পরও তা আদায় করে নিতেন এবং إذا أقيمت الصلاة فلا صلاة إلا المكتوبة এ হাদীসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফজরের সুন্নতকে ভিন্ন মনে করতেন।
হাদীস শরীফে এসেছে :
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৫
দুই. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের পূর্বের দুই রাকাত সুন্নতকে অধিক গুরুত্ব দিতেন যতটা না অন্য কোনো নফল বা সুন্নতকে গুরুত্ব দিতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৩
এ ধরনের আরো অনেক বর্ণনা ফজরের সুন্নতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে অনেক সাহাবী ইকামত শুরু হওয়ার পর অন্য নামায পড়ার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে হাদীসটিকে এক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য মনে করতেন। তারা বরং ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্য চার ওয়াক্তে ইকামতের সময় কোনো ধরনের সুন্নত-নফল শুরু না করার সাথে হাদীসটির বক্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আর ফজরের সুন্নত সম্পর্কিত হাদীসের কারণে তারা ইকামত শুরু হলেও ছোট সূরা দিয়ে অল্প সময়ের ভিতরে তা আদায় করে নিতেন। এতে উভয় হাদীসের উপরই আমল হয়ে যেত।
অবশ্য জামাত শুরু হওয়ার পর ভিন্ন নামায পড়ার দ্বারা যেন তার প্রতি অবজ্ঞা জাতীয় কিছু বোঝা না যায় এজন্য এ সুন্নত পড়তে বলা হয়েছে নিজ ঘরে বা মসজিদের বারান্দায় অথবা অনেক বড় মসজিদ হলে জামাতের স্থান থেকে অনেক দূরে পিছনে গিয়ে কোনো খুটির আড়ালে। যদি তৎক্ষণাৎ এমন জায়গা না পাওয়া যায় তাহলে ঐ সময় সুন্নত না পড়ে বরং জামাতেই শরীক হয়ে যাবে এবং সূর্যোদয়ের পর সুন্নত পড়ে নিবে।
দ্বিতীয় বিষয় হল, কোনো ব্যক্তি যদি ফরযের পূর্বে সুন্নত পড়তে না পারে তাহলে সে তা কখন আদায় করবে?
এক্ষেত্রে দলীল-প্রমাণের আলোকে শক্তিশালী মত হল, এ ব্যক্তি ফজরের সুন্নত সূর্যোদয়ের পর আদায় করবে। ফরযের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে আদায় করবে না। হাদীস শরীফে এসেছে:
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের সুন্নত আদায় করতে পারেনি সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর আদায় করে নেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪২৩
দুই. স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ফজরের সুন্নত ছুটে গেলে তিনি সূর্যোদয়ের পর তা আদায় করে নিতেন।
যেমন বিশুদ্ধ সূত্রে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দুই রাকাত সুন্নত ঘুমের কারণে পড়তে পারেননি, তিনি তা সূর্যোদয়ের পর আদায় করে নিয়েছেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১১৫৫
তিন. উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন এবং আসরের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮৩
এ হাদীসে ব্যাপকভাবেই নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এ নিষেধাজ্ঞার অধীনে ফজরের সুন্নতও শামিল। এ থেকে ফজরের সুন্নতকে বাদ দেয়ার সহীহ ও নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীস নেই। ইমাম তিরমিযী রাহ. এ হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন, সাহাবা ও তাদের পরবর্তী অধিকাংশ ফকীহের মত হল,তারা ফজর ও আসরের পর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে ফরযের কাযা ছাড়া অন্য কোনো নামায পড়াকে মাকরূহ মনে করতেন।
তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের আমল ও নির্দেশনা এবং ঐ সময়ে সুন্নত নফল আদায়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার হাদীস এবং সাহাবা তাবেয়ীনের অধিকাংশের বক্তব্য ও আমল দ্বারা শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত যে, ফজরের সুন্নত ফরযের আগে পড়তে না পারলে সূর্যোদয়ের আগে তা পড়বে না; বরং সূর্যোদয়ের পর আদায় করবে।
আর প্রশ্নপত্রের সাথে সংযুক্ত লিফলেটে ফরযের পর সূর্যোদয়ের আগে সুন্নত পড়ার স্বপক্ষে যে হাদীস পেশ করা হয়েছে সনদের বিচারে তা সহীহ নয়। খোদ ইমাম তিরমিযী রাহ. এ হাদীস বর্ণনা করার পর বলেছেন, এ হাদীসের সনদ মুত্তাসিল নয়। হাদীসের রাবী মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত তাইমী রাহ. কায়েস রাহ. থেকে কোনো হাদীস শুনেননি। সে মতে এ হাদীসটি منقطع যা পূর্বোক্ত মারফু মুত্তাসিল হাদীসের মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আর বায়হাকীর রেওয়ায়েতের বর্ধিত অংশ “ফজরের দুরাকাতও পড়া যাবে না” দলীলযোগ্য নয়। কেননা মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্য অনুযায়ী এ অংশটি সহীহ নয়। স্বয়ং ইমাম বায়হাকী রাহ. এ হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন, আবু আহমাদ বলেন, মুসলিম ইবনে খালিদের সূত্রে আমর থেকে এ হাদীস যারা বর্ণনা করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে নসর ব্যতিত অন্য কেউ তার বর্ণনায় এ অতিরিক্ত অংশ উল্লেখ করেছে বলে আমি জানি না। তিনি আরো বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, আহমদ ইবনে ইয়াসার বর্ণনা করেছেন নসর ইবনে হাজিব থেকে! কিন্তু এটা ভুল (وهم)।
এ ছাড়া নসর ইবনে হাজিব আল মারওয়াযী শক্তিশালী রাবী নন। তার পুত্র ইয়াহইয়াও অনুরূপ। (সুনানে কুবরা, বাইহাকী ২/৪৮৩)
প্রকাশ থাকে যে, লিফলেটে একটি মাসআলা বলা হয়েছে যে, মসজিদে এসে যদি দেখা যায় যে জামাতের দুই/এক মিনিট সময় বাকি আছে তাহলে সুন্নত নামায শুরু করবে না।
প্রশ্ন হল, এটা কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? এ ধরনের কোনো কথা কি সাহাবা তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে?
হাদীস শরীফে তো ইকামত শুরু হলে সুন্নত নফল শুরু করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইকামত শুরুর দুই/ এক মিনিট আগে থেকে সুন্নত নফল শুরু করা যাবে না -এমন কথা তো হাদীস আসারে নেই। তিনি কী করে তা বললেন?
এর চেয়েও অধিক মনগড়া কথা হল “সুন্নত পড়া অবস্থায় যদি একামত শুরু হয়ে যায় আর সুন্নত আদায়কারী ব্যক্তি প্রথম রাকাতে থাকে বা মাত্র প্রথম রাকাত শেষ হলো তাহলে নামায ছেড়ে দিয়ে জামাতে শরীক হবেন” এটা কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? এটা তো বরং আল্লাহ তাআলার নির্দেশনাولا تبطلوا أعمالكم(তরজমা. আর তোমরা তোমাদের আমলকে বাতিল করে দিয়ো না) এর ব্যাপকতার বিরোধী।
ইমাম জাসসাস রাযী রাহ. বলেন, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, যে ব্যক্তি নামায, রোযা, হজ্বসহ যে কোনো সওয়াবের কাজ শুরু করেছে তা পূর্ণ করার আগে বাতিল করা জায়েয নয়। (আহকামুল কুরআন ৩/৩৯৩)
অনুরূপ কথা ইমাম কুরতুবী রাহ.ও বলেছেন। (দেখুন, আল জামে লিআহকামিল কুরআন ১৬/১৬৮)
ইবনে কুদামা রাহ. বলেন, নফল পড়া অবস্থায় একামত হয়ে গেলে এবং জামাত ছুটে যাওয়ার আশংকা না হলে তা পূর্ণ করবে, তা বাতিল করবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ولا تبطلوا أعمالكم (আর তোমরা তোমাদের আমলকে বাতিল করে দিয়ো না।)
-আলমুগনী ২/১২০; শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস ৪১৩৬, ১০/৩২৮; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৯৩৮৫; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস ২৩৯৬
আমি ঢাকা থেকেই প্রথমেই মদীনা শরীফ যাই, সেখানে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ২/৩ দিন অবস্থান করি। তারপর মক্কা শরীফে ওমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি এবং আমি মদীনা থেকে অর্থাৎ মসজিদে নববী থেকে ওমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধি। গাড়িতে উঠলে বাঙ্গালী ড্রাইভার আমাকে বলল, মদীনা থেকে ওমরার নিয়ত করলে হবে না। জুল হুলাইফা মসজিদ থেকে ওমরার নিয়ত করতে হবে। আমি তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশের দুইজন বড় আলেমের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে দুইজনের দুই রকম মতামত পাই। যেমন, একজন বললেন, যেহেতু মদীনা শরীফ ও মসজিদে নববী মীকাতের আগে তাই আপনার ওমরার নিয়ত করা ঠিক আছে। কিন্তু অন্যজন বললেন, যেহেতু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফ থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধেন তাই আপনাকে জুল হুলাইফা মসজিদে এসেই ওমরার নিয়ত করতে হবে। এমতাবস্থায় কোনটি সঠিক? উল্লেখ্য, যুলহুলাইফা মসজিদে এসে পুনরায় অযু-গোসল না করে (ইহরাম বাঁধা এবং অযু আগেই ছিল) ওমরার নিয়ত করেছি। যেহেতু আসরের নামাযের জামাত মাসবুক হিসেবে শরিক হই। তাই ইহরামের নামায না পড়েই শুধু নিয়ত করে নিয়েছি। এটা কি ঠিক হয়েছে? বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার জন্য মসজিদে নববী থেকে ইহরাম করা জায়েয় হয়েছে। কেননা হজ্ব ও উমরার জন্য মীকাত এবং মীকাতের আগে যে কোনো জায়গা থেকে ইহরাম করা জায়েয। কারণ ইহরামের জন্য যে মীকাত নির্ধারণ করা হয়েছে তার অর্থ এই যে, ইহরাম ছাড়া ঐ জায়গাগুলো অতিক্রম করা যাবে না। এ অর্থ নয় যে, মীকাতের আগে ইহরাম করা যাবে না।
একাধিক সাহাবী থেকে মীকাতের অনেক আগেই ইহরাম করা প্রমাণিত আছে। ইবনে আবী লাইলা রাহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হযরত আলী রা. মদীনা থেকে ইহরাম করেছেন। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২৮৩২
নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বাইতুল মাকদিস থেকে ইহরাম করেছেন। -প্রাগুক্ত, হাদীস : ১২৮১৯
আবদুল্লাহ ইবনে সালামা রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আলী রা.-কে সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াত (তরজমা) আর তোমরা আল্লাহর জন্য হজ্ব ও উমরা পূর্ণ করো।)-এর তাফসীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, হজ্ব ও উমরা পূর্ণ করার অর্থ হল, নিজের ঘর থেকে ইহরাম করা।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২৮৩৪; তাফসীরে তবারী ২/২১৩
এ ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., উসমান ইবনে আবীল আস রা., ইমরান ইবনে হুসাইন রা., ইবরাহীম নাখায়ী রাহ., তাউস রাহ.সহ আরো অনেক সাহাবা-তাবেয়ী থেকে মীকাতের আগেই ইহরাম করার কথা বর্ণিত হয়েছে। দেখুন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৮/৩৫-৪০
সুতরাং যুলহুলাইফা মসজিদে এসেই ইহরাম করতে হবে, মদীনা থেকে ইহরাম করা যাবে না- এ কথা ঠিক নয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহুলাইফা থেকে ইহরাম করেছেন এটা যে মীকাত এ কথা বোঝানোর জন্য।
অতএব মদীনা থেকে আপনার ইহরাম করা ঠিক হয়েছে। যুলহুলাইফা এসে পুনরায় ইহরামের নিয়ত করার দরকার ছিল না। তবে পুনরায় নিয়ত করার কারণে কোনো সমস্যাও হয়নি।
-আলমাবসূত, সারাখসী ৪/১৬৬, ১৬৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৭২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৭৭-৪৭৮
অনেক সময় পার্কে হাঁটতে বের হই। সেখানে ভিক্ষুকরা কিছুদূর পরপর বসে থাকে। তারা পথচারীদেরকে সালাম দিতে থাকে।
জানতে চাই, ভিক্ষুকের সালামের উত্তর দেওয়া কি ওয়াজিব?
যে ভিক্ষুক ভিক্ষার উদ্দেশ্যে পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সালাম দেয় তার ঐ সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে প্রকৃত অর্থে সালাম দেয় এবং সালামকে ভিক্ষার মাধ্যম না বানায় তার সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। অবশ্য কোন্ উদ্দেশ্যে সালাম দিচ্ছে তা যেহেতু জানা মুশকিল তাই সকল ভিক্ষুকের সালামের উত্তর দেওয়াই অধিক সতর্কতা।
Ñখুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৩২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩২৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৮/৭৭; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৪২৩
রমযানের শেষ দশকে কোনো ব্যক্তি ইতিকাফরত অবস্থায় পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে বের হলে পথে সালামের আদান-প্রদান করতে পারবে কি না? তদ্রƒপ কারো শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারবে কি না? আমাদের এখানে প্রচলিত আছে যে, ইতিকাফরত ব্যক্তি রাস্তায় কাউকে সালাম দেয় না এবং তাকে সালাম দিলে জবাব দেয় না; বরং কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলে প্রয়োজন সেরে মসজিদে চলে যায়। হুযুরের কাছে এক্ষেত্রে সঠিক মাসআলাটি জানতে চাচ্ছি।
ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। তদ্রƒপ এসময় পথ চলতে চলতে কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৭২
তবে কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না।
Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৭; মিরকাতুল মাফাতিহ ৪/৫২৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২১
(ক) আমরা জানি, মৃত ব্যক্তিকে কবরে তিনটি সওয়াল করা হবে। কিন্তু এমনও লোক আছে যাদের মৃত্যু হয় আকাশে বা সাগরে যাদের লাশ মাটিতে দাফন করার সুযোগ হয় না। তাদেরকে কোথায় সুওয়াল করা হবে?
(খ) অনেক মানুষের লাশ সাগরে দাফন করা হয়ে থাকে সেটিই বা বৈধ কতটুকু?
(গ) সাধারণ মানুষ তো আছেই অনেক আলেমকেও দুআর সময় বলতে শুনি, হে আল্লাহ! অমুকের রূহের মাগফিরাত করুন। আসলে অমুকের রূহের মাগফিরাত করুন হবে, নাকি হে আল্লাহ! অমুককে মাফ করে দিনÑ কোনটি সঠিক?
(ঘ) কবর যিয়ারতের সময় কোন দিকে ফিরে দুআ-দরূদ পড়ব?
(ঙ) কবর সামনে রেখে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা যাবে কি?
ক) মৃত্যুর পর সওয়াল-জওয়াব এবং এর পরবর্তী প্রতিদান ও শাস্তি ইসলামী আকীদার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মৃত্যুর পর সওয়াল-জওয়াব হওয়ার জন্য লাশ মাটিতে দাফন করা এবং লাশ অক্ষত থাকা জরুরি নয়; বরং এ সময়ে বান্দার দেহ যেখানে যেভাবে থাকুক আল্লাহ তাঁর কুদরতে ঐ দেহের সাথে রূহের সম্পর্ক করে দিবেন এবং সওয়াল-জওয়াব ও শান্তি বা শাস্তি সব কিছুই হবে। লাশ মাটিতে দাফন করা হোক বা না হোক এবং লাশ অক্ষত থাকুক বা না থাকুক এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান এবং হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা.সহ অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের আগে এক ব্যক্তি ছিল, যে মৃত্যুর সময় তার ছেলেদেরকে অসিয়ত করেছে যে, আমি তো আল্লাহর নিকট কোনো ভালো আমল জমা রাখিনি। জেনে রাখ,আমি যখন মৃত্যুবরণ করব তোমরা আমার দেহকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে প্রবল বাতাসের দিন সমুদ্রে উড়িয়ে দিবে। অতপর ছেলেরা অসিয়তমতে মৃত্যুর পর তার দেহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে প্রবল বাতাসের দিন সমুদ্রে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরে আল্লাহ তাআলা ঐ ছাইগুলো জমা করে তাকে জীবিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে এ কাজে কিসে প্ররোচিত করল? সে বলল, একমাত্র আপনার ভয়ই আমাকে এ কাজ করতে বাধ্য করেছে। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দিলেন। Ñসহীহ বুখারী,হাদীস ৬৪৮০, ৬৪৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৩৩৫৩; কিতাবুর রূহ ৭৪; মিরকাতুল মাফাতীহ ১/৩১০
খ) সাগরের মাঝে নৌযানে কারো ইন্তিকাল হলে নৌযানটি যদি তীরের নিকটবর্তী হয় এবং অবতরণ করা সম্ভব হয় বা নৌযান গন্তব্যে পৌঁছার আগে লাশে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কা না থাকে তাহলে লাশ ভূমিতেই দাফন করতে হবে। আর যদি নৌযান থেকে ভূমিতে অবতরণ করার আগে আগে লাশে পরিবর্তন ঘটার আশঙ্কা থাকে তাহলে নৌযানেই তার গোসল, কাফন ও জানাযা দিয়ে লাশটি সাগরে ছেড়ে দিবে। সম্ভব হলে লাশের সাথে কোনো ভারি বস্তু যেমন পাথর ইত্যাদি বেঁধে দিবে। যাতে লাশ নিচে চলে যায়। পানিতে ভেসে না থাকে। Ñমুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৯৭৩; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৩৫; ফাতহুল কাদীর ২/১০২; ইমদাদুল ফাত্তাহ ৬৩৯
গ) মৃত্যুর পর শান্তি ও আযাব রূহ এবং দেহ উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এগুলো শুধু রূহের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এটিই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা। তাই কেউ যদি রূহের মাগফিরাত দ্বারা এমন উদ্দেশ্য করে যে, শাস্তি বা শান্তি শুধু রূহেরই হবে তাহলে সেটি ভুল হবে। তাই কথাটি এভাবে বলা উচিত হবে, হে আল্লাহ অমুকের মাগফিরাত করুন। রূহের মাগফিরাত করুনÑ এমনটি না বলাই ভালো। কেননা এতে কারো ভুল বোঝার আশঙ্কা রয়েছে। Ñকিতাবুর রূহ ৬৫-৬৭; ফাতহুল বারী ৩/২৭৫;মিরকাতুল মাফাতীহ ১/৩১০; শরহুস সুদূর ২৪৩
ঘ) কবর যিয়ারতের নিয়ম হল, মাইয়েতের চেহারার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সালাম দিবে। অতপর দরূদ শরীফ ও কুরআন মাজীদ থেকে তিলাওয়াত করতে চাইলে করতে পারবে। অবশ্য উক্ত নিয়মে দাঁড়ানো সম্ভব না হলে যেভাবে সম্ভব সেভাবে দাঁড়াতে পারবে। যিয়ারত শেষে চাইলে কেবলামুখী হয়ে কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে পারবে। Ñজমে তিরমিযী, হাদীস ১০৫৩; আলআওসাত, ইবনুল মুনযির ৫/৫০৭; রদ্দুল মুহতার ২/২৪২; মাজমাউল আনহূর ৪/২২০; মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/২১৯
ঙ) কবরকে সামনে রেখে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা জায়েয আছে। হাদীস শরীফে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার শিয়রে সূরা বাকারার প্রথম এবং শেষের কয়েকটি আয়াত পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
তাই কবরের সামনে কুরআন মাজীদ পড়া দোষণীয় নয়। তবে ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে বিনিময় নিয়ে কুরআন মাজীদ খতম করার যে প্রচলন রয়েছে তা সম্পূর্ণ বিদআত ও নাজায়েয। Ñআল মুজামুল কাবীর, তবারানী ১৯/২২০; আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৫; মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬; ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৬২; ফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়া ২/৩১৯
আমাদের দেশে পুরুষদের মধ্যে সালামের সময় মুসাফাহা করার প্রচলন আছে। কিন্তু মহিলাদের পরস্পরের সাথে মুসাফাহা করার প্রচলন নেই।
হুজুরের নিকট জানতে চাই, মহিলাদের পরস্পরের সাথে মুসাফাহা করা জায়েয আছে কি না?
হ্যাঁ , মহিলাদের জন্যও পরস্পরে মুসাফাহার বিধান রয়েছে। পুরুষের মতো তাদের জন্যও পরস্পরে সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা সুন্নত।
-মুগনিল মুহতাজ ৩/১৭৫; আলমওসূআতুল ফিকহিয়্যাহ ৩৭/৩৫৭-৮