ফতোয়া: মুফতি মেরাজ তাহসিন

ফতোয়া নং: ৪৮৯০
তারিখ: ২০-জুন-২০১৭
বিষয়:

তারাবীহ নামায আট রাকাত নাকি বিশ রাকাত? বিরোধীদের জবাবসহ একটি দালিলিক উত্তর ৷

প্রশ্ন
শ্রদ্ধেয় মুফতী সাহেব! আহলে হাদীসরা বলে তারাবীহ নামায আট রাকাত ৷ বিশ রাকাতের কোন দলিল নেই ৷ বুখারি শরীফে নাকি আট রাকাতের কথা উল্লেখ আছে ৷ এ বিষয়ে দলিল সহ বিস্তারিত জানালে ভাল হত ৷
উত্তর
তথাকথিত নামধারী আহলে হাদীসদের অজ্ঞতার নিদর্শনাবলির মধ্য থেকে একটি হল, বিশ রাকাত তারাবীহ এর কোন দলিল নেই দাবী করা ৷ দেখুন তারাবীহ নামায বিশ রাকাতের প্রমাণ:
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ রমজান মাসে বিশ রাকাত এবং বিতির পড়তেন।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২/২৯৪, হাদীস নং- ৭৬৯২, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-১২১০২; সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯১ ৷
হযরত জাবের রাঃ বলেনঃ রমজান মাসের এক রাতে রাসূল সাঃ বাহিরে তাশরীফ আনলেন। আর সাহাবায়ে কেরামকে ২৪ রাকাত নামায পড়ালেন। (চার রাকাত ইশা বিশ রাকাত তারাবীহ) আর তিন রাকাত বিতির পড়ালেন।
-তারীখে জুরজান-২৭ ৷
হাদীসে একটু দুর্বলতা থাকলেও যদি তার উপর উম্মতের ঐক্যমত্বের আমল পাওয়া যায় তাহলে আমল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার দ্বারা উক্ত হাদীস সহীহ হয়ে যায়।
উম্মতের আমল:
হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ওমর বিন খাত্তাব রাঃ এক ব্যক্তিকে বিশ রাকাত পড়ার হুকুম দিলেন।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা-২/২৯৩ ৷
হযরত সায়েব বলেনঃ হযরত ওমর রাঃ এর সময়কালে বিশ রাকাত তারাবীহ ছিল।
-ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬ ৷
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ রাঃ বলেনঃ আমরা হযরত ওমর রাঃ এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতির পড়তাম।
-সুনানে সুগরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং-৮৩৩ ৷
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ বলেনঃ হযরত ওমর রাঃ এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। আর হযরত উসমান রাঃ এর শাসনামলে লম্বা কেরাতের কারণে লাঠির উপর ভর দিতেন।
-বায়হাকী-৪/২৯৬ ৷
হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী রঃ বলেন, হযরত হযরত আলী রাঃ রমজান মাসে ক্বারীদের ডাকতেন। তারপর তাদের মাঝে একজনকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর বিতিরের জামাত হযরত আলী নিজেই পড়াতেন।
-বায়হাকী-৪/৪৯৬ ৷
হযরত আতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি লোকদের অর্থাৎ সাহাবী ও তাবেয়ীগণকে বিশ রাকাত তারাবীহ এবং তিন রাকাত বিতির পড়তে দেখেছি।
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/৩৯৩ ৷
মদীনায় হযরত ওমর রাঃ, হযরত উসমান রাঃ, হযরত আলী রাঃ এর শাসনামলে বিশ রাকাত তারাবীহই পড়া হতো। আজো মদীনা মুনাওয়ারায় মক্কা মসজিদে হারামে কুফা বসরায় বিশ রাকাত তারবীহই পড়া হয়। জুমহুরে সাহাবা তাবেয়ী চার ইমামের মাজহাবও বিশ রাকাতের স্বপক্ষে এভাবেই চলতে থাকে। ইংরেজ আমলের পূর্বে কোন একজন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ এটাকে অস্বিকার করেননি। শুধু ইংরেজদের দালালরা হাজার বছর পর এসে বিশ রাকাত তারাবীহ কে অস্বিকার করে ৷
১২৮৪ হিজরীর ইংরেজ আমলের আগে বিশ্বের কোন মসজিদে রমজানে আট রাকাত তারাবীহ জামাতের সাথে পড়ার কোন দৃষ্টান্ত নেই। না মসজিদে নববীতে কোনদিন আট রাকাত তারাবীহ পড়া হয়েছে। না বাইতুল্লায়। না পৃথিবীর কোন মুসলিম পল্লিতে। রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে সর্বপ্রথম এ বিদআতের সূচনা হয়।
তাদের অজ্ঞতার আরেকটি নিদর্শন হল, তারাবীহ নামায আট রাকাতের স্বপক্ষে যে, বোখারী শরীফের একটি হাদীস উল্লেখ করে থাকে। হাদীসটি হল, হযরত আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি আয়েশা রাঃ এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, রমযান মাসে নবীজী সাঃ এর নামায কেমন হত ? তিনি বললেন-রাসূল সাঃ রমযান ও রমযান ছাড়া ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেওনা। তারপর পড়তেন ৪ রাকাত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেওনা, তারপর পড়তেন ৩ রাকাত। হযরত আয়েশা রাঃ বলেন-তখন আমি বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন-হে আয়েশা! নিশ্চয় আমার দু’চোখ ঘুমায় কলব ঘুমায়না।
-সহীহ বুখারী-১/১৫৪ ৷
তাদের দাবী হল, ১১ রাকাতের মধ্যে আট রাকাত তারাবীহ আর তিন রাকাত বিতির ৷
এবার আসুন মূল রহস্যে;
উক্ত হাদীস দিয়ে তারাবীহ আট রাকাত প্রমান করা মুর্খতা বৈকিছু নয় ৷ দেখুন তাদের অজ্ঞতা ও মুর্খতার নিদর্শন:
১৷ উক্ত হাদীসে রমযান ও রমযানের বাহিরে এগার রাকাতের কথা উল্লেখ আছে, আর রমযানের বাহিরে কোনো তারাবীহ পড়ার কথা তারাও স্বীকার করে না। সুতরাং উক্ত হাদীস তারাবীর হতে পারে না।
২৷ সাহাবারা হাদীসের উদ্দেশ্য বেশী বুঝতেন, ওমর রাঃ এর জামানায় বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতের সহিত হত সমস্ত সাহাবীর ঐক্কমতে। কেহ অস্বীকার করেন নি, আট রাকাতের কথাও বলেন নি। খুদ আয়েশা রাঃ ও অস্বিকার করেন নি ৷ আয়েশা রাঃ এর উক্ত হাদীস যদি
তারাবীর হত অবশ্যয় সাহাবীদের বিশ রাকাত পড়তে বাধা দিতেন বা অস্বীকার করতেন। অতএব একথা স্পষ্ট যে এটি তারাবীহ এর নয় ৷
৩ ৷ এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় নবীজী সাঃ এক সালামে ৪, ৪ রাকাত করে তারাবীহ আর শেষে এক সালামে ৩ রাকাত বিতর পড়েছেন, অথচ কথিত আহলে হাদিসদের আমল এর বিপরীত। তারা তারাবীহ দুই দুই রাকাত করে পড়েন। আর বিতর এক রাকাত বা তিন রাকাত দুই সালামে পড়েন। সুতরাং যেই হাদিস দলিলদাতাদের কাছে আমলহীন এর দ্বারা কিভাবে দলিল দেয়া যায়?
৪৷ এই হাদিসটি কে ইমাম বুখারী রঃ কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে এনেছেন। এবং সিহাহ সিত্তার অন্যান্য ইমামগনও তাহাজ্জুদ বা অন্য অধ্যায়ে এনে তারাবীহ এর অধ্যায়ে না এনে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, এই হাদিসটি তারাবীর নয় ।
৫৷ এই হাদিসের শেষাংশে আছে "তারপর আয়েশা রাঃ বললেন-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতির পড়ার আগে ঘুমান?" এ বিষয়টি তারাবীহ এর ক্ষেত্রে কিভাবে কল্পনা করা যায় যে, নবীজী সাঃ তারাবীহ নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন আর সাহাবীরা বিতির পড়ার জন্য নবীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। বরং এটি তাহাজ্জুদ এর ক্ষেত্রে ৷ নবীজী সাঃ তাহাজ্জুদ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন আর সাহাবারা ফজর পড়ার জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন ৷
অতএব এই হাদীস দ্বারা কোনভাবেই তারাবীহ নামায প্রমান করা সম্ভব নয় ৷ যে হাদীস দ্বারা কোন মুহাদ্দীস ফকীহ ইমাম তারাবীহ বুঝেন নি ৷ খুদ হয়রত আয়েশা রাঃ এ হাদীস বর্ননা করা সত্তেও কোনদিন বিশ রাকাতের বিরোদ্ধে কথা বলেন নি ৷ এ হাদীসকে আট রাকাত তারাবীর স্বপক্ষে দলিল পেশ করাকত বড় মুর্খতা ও অজ্ঞতা হতে পারে আন্দাজ করুন ৷ এছাড়া আহলে হাদীস ভাইয়েরা আর একটি সহিহ হাদীসও আট রাকাত তারাবীর স্বপক্ষে দেখাতে পারবে না ৷ সুতরাং পুরা উম্মতের হাজার বছরের আমলকে ডিঙিয়ে মনগড়া আট রাকাতের দাবী ডাষ্টিবিনে নিক্ষেপ করা ছাড়া কোন উপায় নেই ৷
আল্লাহ সকলকে সহীহ বুঝ দান ফরমান ৷ আমীন ৷ মুফতী মেরাজ তাহসীন মুফতীঃ জামিয়া দারুল উলুম দেবগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৷

উত্তর দিয়েছেন : মুফতি মেরাজ তাহসিন
এ বিষয়ে আরো ফতোয়া:
এ বিভাতের বাকি সকল ফতোয়া এখানে পাবেন : বিভাগ আদব-ব্যবহার